করোনাভাইরাস: আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহনে বিপর্যয়
চীনে প্রাণঘাতী নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে বৈশ্বিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রায় ৮০ শতাশ পণ্য নৌপথে পরিবহন হয়। এক্ষেত্রে বিশ্বের ১০টি ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দরের সাতটিই রয়েছে চীনে। তার কাছাকাছি সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও একটি করে বড় বন্দর আছে।
চীন থেকে বিশ্বজুড়ে পণ্য বহনকারী শিপিং সংস্থাগুলিকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা সিএনএন বলছে, ধমনীর মধ্যে রক্ত জমাট বেঁধে গেলে মানুষের যে অবস্থা হয় নভেল করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্ব বাণিজ্যেও সেই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
করোনাভাইরাস ছড়ানো রোধে তারা নৌযান চলাচল কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে তাদের পরিষেবার চাহিদা কমে গেছে। এর ফলে আন্তর্জাতিক পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে বলে শিপিং কোম্পানিগুলোর আশঙ্কা।
বিআইএমকো নামে একটি আন্তর্জাতিক শিপিং অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান বিশ্লেষক পিটার স্যান্ড বলেন, বৈশ্বিক উত্পাদনের সংযোগস্থল প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কারণ আন্তঃএশীয় ও বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
“এর ফলে অনেক শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কন্টেইনারবোঝাই পণ্য পরিবহনের চাহিদা সংকুচিত হয়ে পড়বে।”
গাড়ি, যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে পোশাকসহ অন্যান্য ভোক্তাপণ্য পর্যন্ত সব কিছুই কন্টেইনারে পরিবহন করা হয়। কন্টেইনার শিপিং বিপর্যস্ত হলে বাধাগুলি এর প্রভাব চীন ছাড়িয়ে বহু দূর গড়াবে। কারণ দেশটি কারখানা বন্ধ রেখে, শ্রমিকদের আবদ্ধ করে রেখে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলার চেষ্টা করছে।এই স্বাস্থ্য সংকট যত দিন স্থায়ী হবে, বিশ্বজুড়ে পণ্য পরিবহন তত বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। করোনাভাইরাসে ৫৬০ জনের বেশি মানুষ মরেছে, কমপক্ষে ২৮ হাজার সংক্রমিত হয়েছে, যা মূলত চীনেই ছড়িয়েছে, যেখানকার শহরগুলোতে প্রায় ছয় কোটি মানুষ অবরুদ্ধ হয়ে আছে।
গাড়ি নির্মাতা হুন্দাই এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার কারখানা বন্ধ করে দিয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে চীন থেকে যন্ত্রপাতি সরবরাহে বিপর্যয় উত্পাদন স্থগিতে বাধ্য করেছে বলে সংস্থাটির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
নৌপথে পণ্য পরিবহণকারী আন্তর্জাতিক সমিতির মহাসচিব গাই প্লাটেন বলেন, পণ্য উঠা-নামা কমে যাওয়ায় কিছু পণ্যবাহী জাহাজ চীনের বন্দরে ঢুকতে পারছে না। অনেক জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত কাজের জন্য শ্রমিকদের অপেক্ষায় ডকে আটকে আছে।
“আরও অনেক জাহাজ সাগরে ‘ভাসমান কোয়ারান্টিন এলাকায়’ অলস দাঁড়িয়ে আছে। কারণ চীনা বন্দরে ভেড়া এসব জাহাজের ক্রুদের ভাইরাসমুক্ত ঘোষণা না করা পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলি তাদের নিজেদের বন্দরে ঢুকতে দিচ্ছে না।”
দীর্ঘদিন ধরে জাহাজ সাগরে অলস পড়ে থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছেন এমন একজন ক্রুর খবর প্ল্যাটেন নিজেই দিয়েছেন।মার্স্ক, এমএসসি মেডিটেরানিয়ান শিপিং, হাপাগ-লয়েড ও সিএমএ-সিজিএমের মতো বড় বড় শিপিং কোম্পানিগুলো বলছে, চীন ও হংকং হয়ে ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিম আফ্রিকার পথে চলাচলকারী নৌযানের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে।
এসব জাহাজ মালিকরা বলছেন, চীনে বার্ষিক ছুটির মৌসুমে এমনিতেই পণ্য পরিবহনের চাহিদা কমে যায়। তার মধ্যে করোনাভাইরাসের কারণে চীনা কারখানাগুলিকে অলস রাখায় জাহাজের চাহিদা কমে গেছে। একারণে তারাও জাহাজ চলাচল কমিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
প্রায় দুই হাজার জাহাজ মালিক, অপারেটর, ম্যানেজার, দালাল ও এজেন্ট নিয়ে গঠিত বিআইএমকোর সদস্যদের দেওয়া তথ্য উদ্ধৃত করে প্ল্যাটেন বলেন, কয়লা, অপরিশোধিত তেল ও লোহার মতো সমুদ্রপথে পরিবহনযোগ্য পণ্যগুলোর জন্য চীনা ক্রেতাদের কোনো চাহিদা নেই বললেই চলে।
চাহিদা কমায় দাম পড়ে গিয়ে তেলের বাজার মন্দা পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে।
চীন থেকে পণ্য আসতে বিলম্বের বিষয়ে গ্রাহকদের সতর্ক করে দিয়ে জাহাজের বদলে বিমানে, এমনকি সম্ভব হলে ভিন্ন দেশ থেকে পণ্য আনার পরামর্শ দিয়েছে লজিস্টিকস কোম্পানি ফ্রেইটোস।
ফ্রেইটোস বলছে, সাধারণত চান্দ্র নববর্ষের পর জমে থাকা যেসব চালান আসে, বর্তমান পরিস্থিতির কারণে বাজে অবস্থায় পড়বে। সমুদ্র পরিবহনের ভাড়া বেড়ে যাবে এবং অনেক বিলম্ব হবে।
বিপর্যয় বিমানে পণ্য পরিবহনেও শুধু জাহাজে পণ্য পরিবহনই নয়, আকাশপথে পণ্য পরিবহনও ব্যাহত হয়েছে।ব্রিটিশ কোম্পানি আইএজি কার্গো চীনের মেইনল্যান্ডের সঙ্গে অন্তত একমাসের কার্গো ফ্লাইট সোমবার বাতিল ঘোষণা করেছে বলে সরকারের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে।
জামান কুরিয়ার সার্ভিস ডিএইচএল চীনকে কেন্দ্র করে ‘আকাশপথে, ট্রাক ও রেলে পণ্য পরিবহনে মারাত্মক বিপর্যয়ের’ খবর দিয়েছে।
এর ফলে চীনজুড়ে গাড়ি, ওষুধ ও মেডিকেল পণ্য ও উচ্চপ্রযুক্তি খাতের মতো শিল্পগুলোতে সরবরাহ ব্যবস্থা ও উৎপাদনের বড় ধরনের প্রভাব’ পড়বে বলে ডিএইচএলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
ভাইরাসের কেন্দ্রস্থল উহান রাজ্যে পণ্য পৌঁছানো আপাতত বন্ধ রেখেছে ডিএইচএল। এছাড়া অদূর ভবিষ্যতে তাদের কার্যক্রম স্বাভাবিক থাকবে বলে মনে করছে কোম্পানিটি।
চীনে পণ্য আনা-নেওয়া অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছে ইউপিএস ও ফেডেক্স। তবে ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়া সেবার জন্য চাহিদা কমে গেছে বলে ইউপিএস জানিয়েছে।