করোনাকালে কালো ছত্রাক সংক্রমণ কী, কাদের হয়
করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর অনেকে বিরল একটি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগটির নাম মিউকোমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন। বিশেষ করে ভারতে করোনা থেকে সুস্থ হওয়া অনেক রোগী বিরল এই কালো ছত্রাক সংক্রমণে আক্রান্ত হচ্ছেন।
ভারতের ডাক্তাররা বলছেন, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণে মৃত্যু হার ৫০ শতাংশের বেশি। বিরল এই ছত্রাক সংক্রমণ খুবই মারাত্মক যা নাক, চোখ এবং কখনও কখনও মস্তিষ্কেও আক্রমণ করে। এতে আক্রান্ত হয়ে গত কয়েকদিনে প্রায় ১০ জন কোভিড রোগী চোখ হারিয়ে অন্ধত্বও বরণ করেছেন।
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন কী?
মিউকোমাইকোসিস বা ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন খুবই বিরল একটি সংক্রমণ। মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে আসলে এই সংক্রমণ হয়। এই ছত্রাক সাধারণত মাটি, গাছপালা, সার এবং পচন ধরা ফল ও শাকসবজিতে পাওয়া যায়। মুম্বাইয়ের চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. অক্ষয় নায়ারের মতে, এই ছত্রাক সর্বত্র বিদ্যমান। মাটি ও বাতাসে পাওয়া যায়, এমনকি সুস্থ মানুষের নাক ও শ্লেষ্মার মধ্যেও থাকে।
কালো এই ছত্রাক সাইনাস, মস্তিষ্ক এবং ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। ডায়াবেটিস, ক্যানসার, এইচআইভি/এইডস-এর মতো কোনো রোগের কারণে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের জন্য এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।
করোনা থেকে সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা কেন ঝুঁকিতে রয়েছেন?
চিকিৎসকদের মতে, করোনা মহামারির আগে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ খুব বিরল ছিল এবং মূলত দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ব্যক্তিদের মধ্যে দেখা যেত। তবে মহামারি শুরু হওয়ার পর ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণের গতি বাড়াচ্ছে ৩ কারণ- কোভিড নিজে, ডায়াবেটিস এবং স্টেরয়েডের ব্যবহার, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।
মহারাষ্ট্রের মেডিকেল শিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তরের প্রধান ডা. তাতইয়ারাও লাহান বলেন, ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস ইনফেকশন অপরিচিত নয়, কিন্তু কোভিড-১৯ সম্পর্কিত জটিলতার কারণে এতে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তাঁর মতে, করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েডের ব্যবহার থেকে এই সংক্রমণ শুরু হতে পারে।
করোনায় গুরুতর অসুস্থ রোগীদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গে যেসব ক্ষতি হয় সেই ক্ষতি থামানোর জন্য ডাক্তাররা কোভিডের চিকিৎসায় স্টেরয়েড ব্যবহার করেন। কিন্তু এই স্টেরয়েডের ব্যবহার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমিয়ে দেয়। ডায়াবেটিক রোগীদের পাশাপাশি ডায়াবেটিস নেই এমন কোভিড আক্রান্তদের শরীরের রক্তে শর্করার (ব্লাড সুগার) মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়।
ডা. লাহান বলেন, করোনা চিকিৎসায় স্টেরয়েড ছাড়াও কিছু ওষুধ কোভিড রোগীদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার কারণেই মিউকোরমাইকোসিস সংক্রমণ ঘটছে। ছত্রাকটি যদি আক্রান্ত ব্যক্তির মস্তিষ্কে পৌঁছায় তাহলে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণে কী ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়?
ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সাধারণত নাক, উপরের চোয়ালের মধ্যে বাড়তে শুরু করে এবং মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারে। সংক্রমিত রোগীদের সাধারণত যেসব উপসর্গ দেখা দেয় তার মধ্যে রয়েছে: নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নাক থেকে রক্ত পড়া, চোখের নিচে ব্যথা, চোখ ফুলে যাওয়া, মুখের একপাশ ফুলে যাওয়া, মাথাব্যথা, জ্বর, চোখের দৃষ্টিশক্তি কমে যাওয়া।
কোভিড রোগীদের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সংক্রমণ এ বছরই দেখা দিয়েছে?
ডা. লাহেন জানান, গত বছর কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময়েই এই ছত্রাক সংক্রমণের ঘটনা জানা গিয়েছিল কিন্তু সেসময় আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এছাড়া এ ধরনের ঘটনাগুলো গত বছর এত তাড়াতাড়ি জানা যায়নি। কোভিড রোগীরা হাসপাতাল ছাড়ার কয়েক সপ্তাহ পর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে করোনা চিকিৎসা চলাকালীন সময়েই কিছু রোগী এতে আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে এই ছত্রাক সংক্রমণ ভয়াবহ হয়ে ওঠার পাশাপাশি দ্রুত ছড়াচ্ছে।
চিকিৎসকদের মতে, বেশিরভাগ রোগীই তাদের কাছে পৌঁছচ্ছে দেরিতে। যখন তারা দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসেছে। এই পর্যায়ে অস্ত্রোপচার করে চোখ ফেলে দেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কারণ ছত্রাকের মস্তিষ্কে আক্রমণ ঠেকাতে চোখ বাদ দেয়া ছাড় তখন বিকল্প থাকে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীরা দুচোখেরই দৃষ্টি হারাচ্ছেন। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে সংক্রমণ ছড়ানো বন্ধে চিকিৎসকদের রোগীর চোয়ালের হাড়ও কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। তবে সেগুলো একেবারে মারাত্মক সংক্রমণের ক্ষেত্রে।
ইএনটি সার্জন ডা. সঞ্জীব জাম্বান বলেন, সংক্রমণটি নিজে বিরল হিসেবে পরিচিত হলেও কোভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ে বেঁচে যাওয়া লোকজনকে বেশি আক্রান্ত করছে। কেইএম হাসপাতালের ইএনটি প্রধান ডা. হেতাল মারফাতিয়া বলেন, গত দুই সপ্তাহে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগের সংক্রমণের পরিমাণ বেড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ২ থেকে ৩ জন এ জাতীয় রোগী হাসপাতালে আসছেন।
চিকিৎসা কী?
বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্ল্যাক ফাঙ্গাস চিকিৎসা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ অ্যান্টি-ফাঙ্গাল ওষুধের সরবরাহ কম এবং এটি ব্যয়বহুল একটি চিকিৎসা। ডা. লাহেন জানান, ফাঙ্গাসের সংক্রমণ বন্ধ করার জন্য রোগীকে সাধারণত ২১ দিনের জন্য নির্দিষ্ট ধরনের ইনজেকশন দেওয়ার প্রয়োজন হয়।এটাই এই রোগের চিকিৎসায় একমাত্র কার্যকর ওষুধ। এই ইঞ্জেকশনের মূল খরচ প্রতিদিন প্রায় ৯,০০০ রুপি। এর সঙ্গে চিকিৎসা, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, ওষুধ ইত্যাদি মিলিয়ে চিকিৎসা খরচ আরো বৃদ্ধি পায়।
প্রতিরোধে কী করণীয়?
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ছত্রাক সংক্রমণ এড়াতে কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার সময় এবং সুস্থ হয়ে ওঠার সময় সঠিক পরিমাণ স্টেরয়েড ডোজ সঠিক সময়ে নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও-
* হাইপারগ্লাইসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
* করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর ডায়াবেটিস রোগীদের রক্তের গ্লুকোজ স্তর পর্যবেক্ষণ করতে হবে।
* অক্সিজেন থেরাপির সময় হিউমিডাইফায়ার পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে।
* অ্যান্টিবায়োটিক/ অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
* ধুলাময় কোনো নির্মানাধীন সাইটে যাওয়ার সময় মাস্ক ব্যবহার করা লাগবে।
* মাটি (বাগান), শ্যাওলা বা সার ব্যবহারের সময় জুতা, লম্বা ট্রাউজার,লম্বা হাতা শার্ট এবং গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে।