কমছে আয় বাড়ছে খরচ, শ্রীলঙ্কার দৃশ্য প্রকট হচ্ছে নেপালে
‘নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বেড়েই চলেছে, খরচ মেটাতে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে’, কথাটা নেপালি রাজধানী কাঠমাণ্ডুর সবজিবিক্রেতা পম্পা খত্রির। তার এই কথার প্রতিধ্বনি যদিও বিশ্বের বহু জায়গাতেই এখন শোনা যায়, তবে নেপালের এই পরিস্থিতির সঙ্গে শ্রীলঙ্কার কয়েক মাস আগের অবস্থার বিশেষ মিল খুঁজে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
কাঠমাণ্ডুর পার্শ্ববর্তী ভক্তপুর জেলায় বাস করেন দুই সন্তানের মা ৩৭ বছর বয়সী পম্পা। পরিবারের খরচ জোগাতে তাকে প্রতিদিন কঠোর পরিশ্রম করতে হয়। ভোর ৩টায় উঠে পাশের গ্রামে চলে যান সবজি কিনতে, সেখান থেকে প্রায় ৩০ কেজি বোঝা নিয়ে শহরে ফেরেন বিক্রি করার জন্য। এভাবে দিনে তার সর্বোচ্চ আয় হয় ২০ মার্কিন ডলার (১৭শ টাকা প্রায়)।
পম্পা বলেন, আমার স্বামী কাজ করতে পারেন না। তাই পুরো পরিবার আমার উপার্জনের ওপর নির্ভরশীল। দুই ছেলের স্কুলের খরচও আমাকে জোগাড় করতে হয়। তিনি বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম ও পরিবহন খরচ বাড়ছে। এতে জীবন আরও কঠিন হয়ে উঠছে।
এই মুহূর্তে পম্পা খত্রির মতো বেশিরভাগ নেপালির বড় দুশ্চিন্তা হচ্ছে, দু’বছর ধরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম দ্রুত বাড়ছে এবং অদূর ভবিষ্যতে তা নিয়ন্ত্রণে আসার কোনো লক্ষণ নেই। করোনাভাইরাস মহামারির আগেও নেপালে এক লিটার সূর্যমুখী তেলের দাম ছিল ১ দশমিক ৩২ ডলার (প্রায় ১১৫ টাকা)। এখন তার দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে লিটারপ্রতি ২ দশমিক ৩৯ ডলারে (২০৮ টাকা প্রায়) দাঁড়িয়েছে। ভোক্তা সংগঠনগুলো বলছে, দেশটিতে কিছু মৌলিক খাদ্যপণ্যের দাম অন্তত ২০ শতাংশ বেড়েছে।
বিদেশের ওপর নির্ভরতা
প্রায় ২ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যার দেশ নেপালের চারপাশে ভারত ও চীনের সীমান্ত। তবে তারা জ্বালানিসহ প্রয়োজনীয় বেশিরভাগ পণ্য আমদানি করে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশী ভারত থেকে।
আমদানি ব্যয় মেটাতে আবশ্যক নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ক্রমেই কমছে। গত ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মাত্র সাত মাসে হিমালয়সংলগ্ন দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১৬ শতাংশের বেশি কমে ৯৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এর কারণ হিসেবে আমদানি ব্যয় দ্রুত বাড়াকে দায়ী করা হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বাঁচাতে নেপাল সরকার এরই মধ্যে গাড়ি, কসমেটিকস, স্বর্ণসহ অনাবশ্যক বিলাসবহুল পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ করেছে।
তবে এই সংকটে নেপাল একা নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাও মূল্যস্ফীতির সমস্যায় ভুগছে। আর ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলেছে। নেপালের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানি চলতি বছরের শুরু থেকে অন্তত চারবার জ্বালানির দাম বাড়িয়েছে।
কাঠমাণ্ডুর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ক্রেতারা এখন জিনিসপত্র কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে এবং দাম কমাতে অনেক দরাদরি করছে। এক ব্যবসায়ী জানান, জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় তাদের সবজিসহ অন্যান্য পণ্য পরিবহনে বাড়তি খরচ করতে হচ্ছে।
নেপালের রাস্তায় প্রতি বছর কয়েক হাজার নতুন গাড়ি নামছে। তাতে বাড়ছে জ্বালানি চাহিদাও। এ বিষয়ে নেপালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী জ্ঞানেন্দ্র বাহাদুর কারকি বলেন, পেট্রোলিয়াম পণ্যের ব্যবহার কমাতে আমরা দুই দিন সাপ্তাহিক ছুটি ঘোষণার কথা বিবেচনা করছি।
শুধু তা-ই নয়, নেপালি কর্তৃপক্ষ শহরগুলোতে ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলেও বিধিনিষেধ দিতে পারে। সেক্ষেত্রে জোড়-বিজোড় নাম্বার প্লেট পদ্ধতি চালুর পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে নেপালের ভোক্তা অধিকার ফোরামের সুবর্ণা প্রভা গুরাগাইন সতর্ক করে বলেছেন, দেশটিতে দরিদ্র দিনমজুররাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় রয়েছে। তার কথায়, খাদ্যমূল্য বৃদ্ধির হার অভূতপূর্ব। এখনকার পরিস্থিতি ২০১৫ সালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের চেয়েও ভয়াবহ। মানুষ খুবই অসন্তুষ্ট।
নেপালের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস প্রবাসীরা। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি কাজ করছেন। ২০২০ সালে তারা প্রায় ৮০০ কোটি ডলার স্বদেশে পাঠিয়েছেন, যা নেপালের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। করোনাকালে এই প্রবাসী আয়ের ওপর ভর করেই অনেক পরিবার এখনো টিকে রয়েছে।
নেপালের অর্থনীতিবিদ ড. পোশ রাজ পাণ্ডে বলেন, করোনায় লকডাউনের কারণে অনেক লোক চাকরি হারিয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও বেড়েছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, এসবের কারণে নেপালে অতিরিক্ত প্রায় ১২ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে।
নেপালে স্থানীয় নির্বাচন ঘনিয়ে আসছে এবং চলতি বছরের শেষের দিকে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ অবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে জনমনে অসন্তোষ ক্ষমতাসীন কংগ্রেস জোটের জন্য শুভকর নয়। দেশটির পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার মতো উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে যেকোনো সময়। অবশ্য নেপাল সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, শ্রীলঙ্কায় কী ঘটছে সেদিকে তারা নিবিড়ভাবে নজর রাখছেন।