ঐক্যফ্রন্ট ছাড়লেন কাদের সিদ্দিকী
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
আট মাসের গাঁটছড়া ছিঁড়ে কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে গেলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি আবদুল কাদের সিদ্দিকী। তার ভাষায়, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে যে জোট তারা গড়েছিলেন, নির্বাচনের পর গত সাত মাসে তার কোনো অস্তিত্ব এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
জাতীয় কোনো সমস্যাকে তারা তুলে ধরতে পারছে না। এরকম একটি জোট যে আছে, তা দেশের মানুষ জানেই না। গতকাল সোমবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার ঘোষণা দেন কাদের সিদ্দিকী।
তিনি বলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অস্তিত্ব বা ঠিকানা খোঁজার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে জনগণের সকল সমস্যায় তাদের পাশে থাকার অঙ্গীকারে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নতুন উদ্যমে পথচলা শুরু করবে। এক সময়ের আওয়ামী লীগ নেতা কাদের সিদ্দিকী আলাদা দল গঠনের পর গত এক দশকে বিএনপির জোটে না ভিড়লেও কাছাকাছিই ছিলেন।
গত ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগের এক সময়কার আরেক নেতা কামাল হোসেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার প্রায় এক মাস পার ৫ নভেম্বর ওই জোটে যোগ দেন তিনি।
খেলাপি ঋণের কারণে ওই নির্বাচনে কাদের সিদ্দিকী অংশ নিতে না পারলেও টাঙ্গাইলে তার আসনে প্রার্থী করেন মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকীকে। ওই নির্বাচনে ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলে ফল প্রত্যাখ্যানের পর বিএনপি ও গণফোরামের সংসদে যোগদানে ক্ষুব্ধ ছিলেন কাদের সিদ্দিকী।
সংসদে যোগদান নিয়ে প্রশ্ন তুলে গত ৯ মে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাতজন সংসদ সদস্যের শপথ নেওয়ার সঠিক ব্যাখ্যা না পেলে তারা আর জোটে থাকবেন না। এরপর কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে বৈঠক করে কামাল বলেছিলেন, নানা প্রশ্ন এলেও তাদের জোট ভাঙছে না।
কাদের সিদ্দিকীও বলেছিলেন, তিনি তার প্রশ্নের উত্তর পেতে আরও সময় দিচ্ছেন ঐক্যফ্রন্টকে, কিন্তু জোট ছাড়ার কোনো ‘আল্টিমেটাম’ তিনি দেননি। তার এক মাস না যেতেই সংবাদ সম্মেলন করে ঐক্যফ্রন্ট থেকে গাঁটছড়া ছাড়ার ঘোষণা দিলেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের সভাপতি।
লিখিত বক্তব্যে সরাসরি উলেখ না থাকায় এক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, আপনার দল কি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে দিল? উত্তরে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমার মনে হয় না যে এখানে কোনো অস্পষ্টতা আছে। সত্য কথা বলতে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এখন খুঁজে পাওয়া যায় না। তার কোনো কর্মকাণ্ড নেই। সেজন্য সেখান থেকে আমরা চলে আসছি।
আমাদের প্রত্যাহার করছি- এই শব্দটা ব্যবহার করা আমাদের কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হয় নাই। সেজন্য খোঁজার কথাটা বলেছি, আমাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি। আপনি যেটা বলেছেন, সেটাকেই বোঝায়।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ‘অকার্যকর’ অবস্থার জন্য কে দায়ী- প্রশ্ন করা হলে কাদের সিদ্দিকী বলেন, আমিসহ কৃষক শ্রমিক জনতা লীগসহ যারা ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছিলেন, কমবেশি সকলেই দায়ী।
কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের পরবর্তী পথচলার বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা সব সময় দেশবাসীর কাছে বিশ্বস্ত থাকার চেষ্টা করেছি, ভবিষ্যতে সেই চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।
নতুন কোনো জোটে যাচ্ছেন কি না- এই প্রশ্নে কাদের সিদ্দিকী বলেন, রাজনীতি একটা প্রবাহমান নদীর মতো, এটা গ্রোতধারার মতো। গণতন্ত্রকামী প্রতিটি মানুষের সাথে আমাদের কাজ করা উচিত। সেক্ষেত্রে ঐক্যফ্রন্টে যারা ছিলেন, তাদের সাথে ভবিষ্যতে কোনো কাজ করব না, এমন কোনো শর্ত নেই। নিভের্জাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমরা কাজ করব।
তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের জোটে না যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচনের পরপর আমি বলেছিলাম, আর কিছু হোক বা না হোক, বর্তমান সরকারি দল ভবিষ্যতে কোনো দিন একটি সুষ্ঠু নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবে না, সেই রাস্তাটা তারা নিশ্চিত করেছে। আমরা সমমনা গণতন্ত্রপ্রেমী এই দেশের প্রতিটি দলের সাথে আমরা কাজ করার চেষ্টা করব।
একাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে এজন্য জোটের মূল নেতা কামালের বদলে জোটের বড় দল বিএনপিকেই দায়ী করেছেন কাদের সিদ্দিকী। তিনি বলেন, নির্বাচন হয়েছে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ফ্রন্টের ব্যানারে। কিন্তু জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়ন ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে দেওয়া হয়নি, ফ্রন্টের যে অফিস ছিল সেখান থেকেও দেওয়া হয়নি।
এটা দেওয়া হয়েছে মাননীয় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার গুলশানের কার্যালয় থেকে। মূলত নেতৃত্ব করেছে বিএনপি। এই জিনিসটা খুবই গুরুতর অন্যায় হয়েছে এবং ঐক্য গঠনের নীতিমালার পরিপন্থি হয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেন, এত কিছুর পরও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের হাজার বছরের সাফল্য ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচন সরকার কর্তৃক প্রহসনে পরিণত হওয়াটি উন্মোচিত করতে পেরেছে। এই নির্বাচন না হলে সরকার যে এমন উলঙ্গভাবে দুষ্কর্ম করতে পারে, এটা কেউ জানত না, বিশ্বাসও করত না।
নির্বাচনের পর গণফোরামের বিজয়ী প্রার্থী সুলতান মো. মনসুর আহমেদের শপথ গ্রহণের বিষয়টি উলেখ করে কাদের সিদ্দিকী বলেন, এটা জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। জাতির পেছনে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে, মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করা হয়েছে। শুধু মনসুর নয়, যারাই শপথ নিয়েছেন, সেটাকে মীরজাফরের চাইতেও খারাপভাবে দেখা যেতে পারে।
ভোটের পর গণফোরামের সুলতান মনসুর যখন শপথ নেন, তখনও সংসদে যোগ না দেওয়ার পক্ষে অবস্থান ছিল বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের। জোটের চাপে তখন গণফোরাম সুলতান মনসুরকে বহিষ্কারও করেছিল। কিন্তু এরপর বিএনপির একজন শপথ নেওয়ার পর তাকেও বহিষ্কার করে দলটি। তার কয়েক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত বদলে সংসদে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।
বিএনপির ‘দ্বৈতনীতি’ তুলে ধরে কাদের সিদ্দিকী বলেন, একজনকে বহিষ্কার ও চারজনকে দলীয় অভিনন্দন- এটা কী ব্যাপার আমরাও বুঝতে পারিনি। অন্যদিকে বিএনপি মহাসচিব (মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর) শপথ গ্রহণ না করায় তার আসন শূন্য হওয়ায় তার আসনে আবার বিএনপি নির্বাচন করে সংসদে গেল! যদি বিএনপিকে সংসদে যেতে হবে, তাহলে ফখরুল ইসলাম আলমগীর কেন গেলেন না? জাতির কাছে স্পষ্ট হয়নি। নৈতিকভাবে এর কোনো জবাব নেই।
বিএনপির এই অবস্থান নিয়ে তার দলের মধ্যেই বিভিন্ন নেতা প্রশ্ন তুলেছেন। প্রশ্ন উঠেছে তাদের আরেক জোট ২০ দলেও। এই কারণে আন্দালিব রহমান পার্থ নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোটও ছেড়েছে।সংবাদ সম্মেলনে কাদের সিদ্দিকীর স্ত্রী নাসরিন সিদ্দিকী, মেয়ে কুঁড়ি সিদ্দিকী, দলের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান তালুকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুলাহ, আমিনুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।