November 25, 2024
আঞ্চলিকলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

‘এখনও ধর্ষিত হইনি। কিন্তু হতে পারতাম, বহুবার!’

এবার খুবি শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ সাবেক শিক্ষার্থীর

দ. প্রতিবেদক
এবার খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারি অধ্যাপকের যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে মুখ খুললেন তারই ডিসিপ্লিনের একজন সাবেক শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন কিভাবে শিক্ষকের দ্বারা হয়রানির শিকার হয়েছেন, সে বিষয়টি তুলে ধরেছেন নিজের ফেসবুক আইডিতে। ওই শিক্ষকের নাম মোল্লা আজিজুর রহমান, তিনি ইংরেজি ডিসিপ্লিনের সহকারি অধ্যাপক। যদিও তিনি এ অভিযোগকে ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং উদ্দেশ্যমূলক বলে দাবি করেছেন।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ডিসিপ্লিনের সাবেক শিক্ষার্থী শামছুন নাহার রাখি তার নিজস্ব ফেসবুকে উল্লেখ করেন, ‘এখনও ধর্ষিত হইনি। কিন্তু হতে পারতাম, বহুবার! আজকে একটা ঘটনা বলি।
২০০৯ সাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সেমিস্টারের পিএল চলে। সাথে ঈদের ছুটিও ছিল সম্ভবত। ডিসিপ্লিন বন্ধ। বাসায় বসে টিভি দেখছিলাম। এরমধ্যে ফোন আসলো সিআর বায়জিদ আলম খান এর নম্বর থেকে। ও বলল, মোল্লা আজিজুর রহমান স্যারের ক্লাস টেস্ট দিছিলি তুই? তোর শীট তো স্যার খুঁজে পাচ্ছেন না। এইমাত্র বললেন আমাকে। স্যার তোকে ফোন করে কনফার্ম করতে বলেছেন। ফোন কর জলদি। ফোন করলাম।
– সিটি দিয়েছিলে?
-জি, স্যার। দিয়েছি তো!
-খুঁজে পাচ্ছি না। আচ্ছা, দেখি আরও খুঁজে। পেয়ে যাবো হয়তো। (ধানাইপানাই)… আচ্ছা, তুমি কী একটা সমস্যা নিয়ে আসছিলে না? এখন আমি ফ্রি আছি। আসতে পারো।
মনে পড়ে গেল, কী কারণে যেন রুমানা ম্যামের রুমের সামনে উঁকি মারছিলাম। স্যার দেখে বলেছিলো, কী সমস্যা? হঠাৎ কী বলবো, পড়াশুনা বিষয়ক একটা প্রশ্ন হাজির করলাম। স্যার বলেছিল, এখন ব্যস্ত। পরে এসো। মাথা নেড়ে বিদায় হলাম। স্যার তো কারণে অকারণে আমাদের ইনসাল্ট করার জন্য মুখিয়ে থাকে। হঠাৎ যেচে পড়ে উপকার করতে চাইছে! খটকা লাগলো। বললাম, ঠিক আছে, স্যার। প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছি। সমস্যা নাই। ধন্যবাদ।
– টার্ম ফাইনালের প্রস্তুতি কেমন চলছে? তুমি এলে কিছু ব্যাপারে গাইডলাইন দিতে পারি।
আমার সন্দেহ বাড়লো।
-স্যার, ছুটি চলছে তো। ডিসিপ্লিন কি কোনো কারণে খোলা?
– না, আমার বাসায় চলে আসো। তুমি নিরালা এলাকা চেনো?
এবার আমি মোটামুটি নিশ্চিত, ব্যাটার মতলব খারাপ। কারণ উনার সাথে আমার এমন কোন সখ্যতা হয়নি যে আমার জন্য তার দরদ এতো উতলাইয়া পড়বে!
তবু কড়াভাবে কিছু বলতে পারিনি (এখন হলে ওর কপাল খারাপ আছিলো)। তাই
ছুতা দেয়া শুরু করলাম।
– না, স্যার। তেমন একটা চিনি না। ভেতরে যাইনি (মিছা কথা। ছাত্রী পড়াই নিরালায়)।
– সমস্যা নেই। ইজি এড্রেস। বলে দিলেই আসতে পারবে।
স্যার, আমার ছাত্রছাত্রী আসবে বিকেলে। এখন প্রায় দুটো বাজে। আর আমার বাড়ি ফুলতলা, নিরালা থেকে একঘণ্টার পথ।
– ও, আচ্ছা। ফোন রেখে দিলো সে।
পাশে বড় আপা বসে ছিল। ফোন লাউড মোডে দেয়া ছিলো, সব শুনেছে আপা। আমি শুধু তার দিকে তাকিয়ে বললাম, কী হলো এটা!
বড়আপা বললো, একদম সাবধানে থাকবি এর ব্যাপারে। উদ্দেশ্য ভালো না।
আমি বললাম, সে তো বুঝতেই পারছি। আমি বরং যাই। গিয়ে দেখি ও আমার কী ছিঁড়তে পারে।
– কোনো বীরত্ব দেখানোর দরকার নাই। পুরুষ মানুষের সাথে গায়ের জোরে পারবি না। এড়িয়ে চলাই নিরাপদ। কেউ ওর দিকে আঙুল তুলবে না, তোর দিকে তুলবে।
-আমার কি দুর্নামের অভাব আছে? আর কী হবে? আর একা তো যাবো না। নাইম হাসান, অনিন্দ্য মুনাসিব, বায়জিদ ওদের নিয়ে যাবো। হাতেনাতে ধরবো ব্যাটাকে।
যাই হোক, আমার মাস্টারপ্ল্যান খারিজ করে দিলো বড় আপা। এরই মধ্যে আবার ফোন বাজলো। শ্রদ্ধেয় স্যারের নম্বর!
– শোনো, তোমার ছাত্রদের আজকে আসতে মানা করে দাও।
– ওদের সবার নম্বর নাই আমার কাছে। আর সামনে ওদের ভর্তি পরীক্ষা তো। এখন মিস দিলে ক্ষতি হবে, স্যার।
কোনোভাবেই হচ্ছে না দেখে রণে ভঙ্গ দিল শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আমার।
মাথা পুরাই খারাপ নাকি এই লোকের! এ কী নির্লজ্জ পারসুয়েশন!
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আবার কল বাজলো। আবারও স্যার। বলল, শোনো, আমি যে তোমাকে ফোন করে আসতে বলেছি এটা তোমার বন্ধুদের বলো না। ওরা তোমাকে খারাপ ভাবতে পারে। তুমি তো সহজ সরল মেয়ে। অনেক কিছু বুঝবে না। ওরা নানান কথা ছড়াবে যদি শেয়ার করো।
-জি, স্যার। বলবো না।
(বলা বাহুল্য, আমার চেহারায় গাধা ভাব প্রকট!)
এরপর থেকে শুরু হলো স্যারের সাথে আমার ঠান্ডা যুদ্ধ!
ক্লাসে তার দিকে এমনভাবে তাকাতাম, যেন চোখ দিয়েই বলে দিতাম, কী … পড়ান আপনি। ভাড়ামি যতসব!
আর সেও তার প্রেমের নিদর্শন দেখাতো পরীক্ষার খাতায়। পুরো চার বছর তার সব কোর্সে দরিদ্র ফলাফল। রেজাল্ট নিয়ে আফসোস করি না। কিন্তু হাজার উপায়ে মানসিক অত্যাচার করেছে, ক্লাসে অপমান করেছে। আফসোস হয়, কেন তখন রেজাল্ট খারাপের ভয়টাকে পাত্তা দিছিলাম!
ফেসবুকে এই পোস্টের কমেন্টে অনেকেই তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেছেন।
ইংরেজি ডিসিপ্লিনের সাবেক শিক্ষার্থী ও অগ্রণী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার প্রজ্ঞাদীপ্ত হালদার নামে একজন লেখেন, ‘রাখি, তুই নিশ্চয়ই জানিস যে, তোর একার সাথেই এই জানোয়ারটা এমন ব্যবহার করেনি। ডিসিপ্লিনের আরো কয়েকজনের সাথেও এটা করেছে ঐ জানোয়ারটা, তোকে আগেই বলেছি। একবার তো নিরালা ২নং এর চিপায় অন্যভাবেও দেখেছি একে। যাইহোক, তুই যে সাহস করে এই পাবলিক প্লাটফর্মে সব বললি, এ জন্য তোকে সম্মান জানাই। সবার এই সাহসটা থাকেনা, যেটা থাকা উচিত। ভালবাসা নিস, সবসময়।’
দেবাঞ্জন ঘোষ নামে একজন লেখেন, ‘আপু, এই লোক আমাদের (ইউআরপি-১৫) ক্লাস নিতো। উনি খুব হাসিমুখে ওনার নিজের মেয়েকে নিয়ে আপত্তিকর কথা বলত। বাকীটা বুঝে নিতে কারো অসুবিধা হতো না।’
এ বিষয়ে ইংরেজি ডিসিপ্লিনের সহকারি অধ্যাপক মোল্লা আজিজুর রহমান বলেন, ‘ এটি একটি ধারাবাহিক ষড়যন্ত্রের অংশ এবং উদ্দেশ্যমূলক। ১১ বছর আগের ঘটনা এখন কেন এভাবে আসবে? তিনি দাবি করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাকে সম্পৃক্ত করতে না পেরে একটি মহল তাকে ফাঁসাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কয়েক বছর আগে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের ফরম পূরণ করে আমাকে সদস্য হতে বলে একটি মহল। কিন্তু আমি নিরপেক্ষ থেকে একজন আদর্শ শিক্ষক হতে চেয়েছি। কখনো রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে চাইনি। তখন থেকেই ওই মহল আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে চলেছে। আমাকে চাকুরিচ্যুত করারও হুমকি দেয়া হয়েছিলো। এটিও ওই ষড়যন্ত্রের অংশ।’
এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলের পরিচালক মোসাঃ হোসনেয়ারা বলেন, ‘ ফেসবুকে যে কেউ যেকোন বিষয় লিখতে পারে। তার উপর ভিত্তি করে কিছু করা আমাদের নীতিমালার বাইরে। তবে আমাদের কাছে কেউ যদি লিখিত অভিযোগ দেয়, তবে আমরা তদন্ত করতে পারি কিংবা সভায় তুলতে পারি। এর আগে কোন বিষয় নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। ’

দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ এম জে এফ

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *