একটি দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে?
অর্থনৈতিক সঙ্কটে ধুঁকতে থাকা শ্রীলঙ্কা সরকার সব বিদেশি ঋণের কিস্তি পরিশোধ সাময়িকভাবে স্থগিত ঘোষণা করেছে, সে দেশের গণমাধ্যম একে দেখছে ‘দেউলিয়া হওয়ার ইঙ্গিত’ হিসেবে।
দেশটির অর্থ সচিব মাহিন্দা সিরিবর্ধনে সাংবাদিকদের বলেছেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সহায়তা পেলে তাদের বিদেশি ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে এই গাড্ডা থেকে বেরিয়ে আসা সহজ হবে।
তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিদেশি ঋণ পরিশোধে শ্রীলঙ্কার সুনাম রয়েছে। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারীর দুই বছরের ধাক্কার পর ইউক্রেইনে রাশিয়ার অভিযান শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে দুর্দশার পথে নিয়ে এসেছে।
এ পরিস্থিতিতে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে বেশি দরকার বিদেশি মুদ্রা। আর সেজন্য দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাকের গভর্নর নন্দলাল ভীরাসিংহে এই ক্রান্তিকালে প্রবাসী লঙ্কানদের আরও বেশি করে বিদেশি মুদ্রা পাঠানোর আহ্বান জানিয়েছেন।
শ্রীলঙ্কা কি তাহলে সত্যিই দেউলিয়া হতে বসেছে? কোনো দেশের দেউলিয়া হওয়ার দশা হলে কী ঘটে? কোনো দেশ কি দেউলিয়া হতে পারে? এক প্রতিবেদনে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে ইনডিয়া টাইমস।
শ্রীলঙ্কার সমস্যাটা কোথায়?
ভাণ্ডারে বিদেশি মুদ্রার মজুদ ফুরিয়ে এসেছে, বাজারে খাবারসহ নিত্যপণ্যের দাম আকাশ ছুঁতে চলেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকটে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হওয়ার দশা। আর্থিক সঙ্কটে থেকে শ্রীলঙ্কা সব মিলিয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের দুয়ারে পৌঁছে গেছে।
আর সে কারণেই বলা হচ্ছে, ২০২২ সালেই হয়ত দক্ষিণ এশিয়ার এই দ্বীপ দেশ দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, শ্রীলঙ্কার এই বিপর্যয়ের প্রধান কারণ অপ্রয়োজনীয় বড় প্রকল্পে সরকারি ব্যায় বৃদ্ধি। আর সেটা করতে গিয়ে বিদেশি ঋণ গেছে বেড়ে। ঋণ বাড়ায় কিস্তি বাবদ নিয়মিত দায়ের অংকও গেছে বেড়ে। আবার জনগণকে ঠাণ্ডা রাখতে কর কমিয়ে আনা হয়েছে, তাতে কমেছে সরকারের আয়।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কাকে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার বিদেশি ঋণ শোধ করতে হবে, অথচ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে মাত্র ১৫ কোটি ডলার, যা তাদের ইতিহাসে সর্বনিম্ন। এছাড়া ২০২৩ থেকে ২০২৬ সালের মধ্যে শ্রীলঙ্কাকে আরও আড়াই হাজার কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে হবে।
এর মধ্যে এসেছে দীর্ঘ মহামারী। দেশের বড় আয়ের উৎস যে পর্যটন খাত, সেখানে রীতিমত খা খা শূন্যতা।
আন্তর্জাতিক ঋণ আর দেশের ভেতরে সরকারের দায় মেটাতে শ্রীলঙ্কা নতুন টাকা ছাপাচ্ছে যা মূল্যস্ফীতির আগুনে ঘি ঢালছে।
মানুষ যেন চাল আর চিনির মত নিত্যপণ্য ন্যায্য মূল্যে কিনতে পারে, সেজন্য বছরের শুরুতেই সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা সরকার। তাতে উপকার কিছু হয়নি। মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
বিশ্ব ব্যাংকের ধারণা, মহামারীর শুরু থেকে শ্রীলঙ্কায় ৫ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। এই সংখ্যা দারিদ্র্য বিমোচনে শ্রীলঙ্কার পাঁচ বছরের সাফল্যের সমান।
সরকার চলে কীভাবে?
একটি আদর্শ বিশ্বে, সরকারগুলো তাদের কর আর বিনিয়োগ থেকে যা আয় করে, তাই তারা ব্যায় আর দায় মেটাতে খরচ করে। আবার আমাদের যখন আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে গেছে ধার করতে হয়, সরকারও ঠিক তাই করে।
সরকার দুইভাবে ঋণ করে। বন্ড ছেড়ে দেশের নাগরিকদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, যেখানে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে নির্দিষ্ট হারে সুদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি থাকে।
আবার বিদেশ থেকেও সরকার দীর্ঘমেয়াদী ঋণ নিতে পারে এবং বিদেশি মুদ্রায় বন্ড ছেড়ে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে পারে। সরকারের এই ঋণকে বলা হয় সার্বভৌম ঋণ।
দেশের ভেতরের ঋণ দেশীয় মুদ্রায় শোধ করা যায়, সরকার কর বাড়িয়ে, সুদের হার কমিয়ে, কিংবা ঠেকায় পড়লে নতুন টাকা ছাপিয়ে সেই ঋণ সামাল দিতে পারে। কিন্তু বিদেশি ঋণ শোধ করতে হয় বিদেশি মুদ্রায়। ফলে দরকার হলে আয়বর্ধক বিনিয়োগের খাত থেকে ডলার সরিয়ে সেই ঋণ শোধ করতে হয়। পরিস্থিতি তখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে না।
রাষ্ট্র কখনও দেউলিয়া হয় না
ইনডিয়া টাইমস লিখেছে, যদি কোনো দেশ দেউলিয়া হয়ে যাচ্ছে বলা হয়, তাহলে সেটা ভুল বলা হবে।
যখন কোনো দেশ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়, তারা দেউলিয়া হয়ে যায় না; তারা ঋণ খেলাপি হয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, খেলাপি হয় সরকার, রাষ্ট্র নয়।
শ্রীলঙ্কার ঘটনায় সংবাদ শিরোনাম দেখে কারও মনে হতে পারে, কোনো দেশের সরকারের খেলাপি হওয়া বোধ হয় বিরল ঘটনা, আসলে তা নয়। বেশিরভাগ দেশই তাদের ইতিহাসে কোনো না কোনো সময় খেলাপি হয়েছে বা তাদের ঋণ পুনর্গঠন করেছে।
প্রথম উন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছে ১৮০ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতাই গ্রিসের প্রথম ঋণ খেলাপি হওয়ার ঘটনা নয়। দেশটি প্রথম ঋণ খেলাপি হয়েছিল সেই ৩৭৭ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে। ১৮২৯ সালে স্বাধীন হওয়ার পর সেদেশের ইতিহাসের অর্ধেক সময়ই ঋণ খেলাপি হয়েছে এথেন্সের সরকারগুলো।
অন্যদিকে সবচেয়ে বেশিবার ঋণ খেলাপি হওয়া ইউরোপীয় দেশ স্পেন। আঠারো থেকে উনিশ শতকের মধ্যে ১৫ বার ঋণ শোধে ব্যর্থ হয়েছে দেশটি।
ঋণ খেলাপি হওয়া ঠেকাতে আইএমএফের সদস্য দেশগুলো নিয়মিতই বেইলআউট বা সহায়তা চুক্তি করে সংস্থাটির সঙ্গে। আইএমএফ শুধু আর্থিক সহায়তাই দেয় না, বেইলআউট কর্মসূচি দেখভালের জন্য তাদের কারিগরি অভিজ্ঞতাও রয়েছে।
কিন্তু বেইলআউটের অর্থও শর্ত ছাড়া মেলে না। ওয়াশিংটন সম্মতি চুক্তির ভিত্তিতে নির্ধারিত বিভিন্ন শর্ত মেনে চলতে হয় বেইল আউট নেওয়া দেশকে। ব্যয় সংকোচন, মুদ্রার অবমূল্যায়ন এবং বাণিজ্য উদারিকরণের মত পদক্ষেপ তারা নিতে বাধ্য হয় ইচ্ছে না থাকলেও।
কী কারণে একটি দেশ খেলাপি হয়?
ঋণ নেওয়ার পর তা কাজে লাগানোর অদক্ষতা বা খামখেয়ালি পদক্ষেপ সেই দেশকে খেলাপি হওয়ার পথে নিয়ে যায়। যখন একটি দেশের সরকার পরিবর্তন হয়, নতুন সরকার প্রায় ক্ষেত্রেই খেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে আগের সরকারের করা ঋণের বোঝা কাঁধে চেপে যাওয়ায়। তখন তাদের ঋণ পুনর্গঠনের পথে হাঁটতে হয়।
একটি দেশ খেলাপি হওয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। আন্তর্জাতিক তারল্য প্রবাহের স্রোত বদলে গেলে কিংবা রাজস্ব আদায় কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে সরকারের তহবিলে টান পড়ে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০১০ সালে জ্যামাইকার ৭৯০ কোটি ডলারের ঋণ খেলাপি হওয়ার কারণ ছিল সরকারের অতিরিক্ত খরচ এবং দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আয়ের খাত পর্যটনে ধস।
একটি দেশ খেলাপি হলে তারপর কী ঘটে?
ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হলে ঋণদাতারা তাদের সম্পদ অধিগ্রহণ করে। কিন্তু একটি দেশের সম্পদ অধিগ্রহণ করা যায় না, বিদেশি ঋণদাতারা তা করতে পারে না এবং খেলাপি হওয়া যে অর্থ সরকারের কাছে থাকে না, সেটা পরিশোধে তাদের বাধ্যও করা যায় না।
তবে একটি বিদেশে ওই দেশের সরকারি কোনো সম্পদ থাকলে অন্য কথা। ২০১২ সালে আর্জেন্টিনা যখন খেলাপি হল, ওই সময় ঘানায় থাকা তাদের নৌবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ জাহাজকে জব্দ করা হয়েছিল।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খেলাপি দেশের কাছ থেকে পাওনা আদায়ের একমাত্র পথ হল ঋণ পরিশোধের শর্তগুলো নিয়ে আবার আলোচনায় বসা। সরকারি বন্ডের বাদ পড়া কিস্তিগুলোর পুনঃতফসিল করা, যার মানে, বন্ডের দাম তখন কমে যাবে।
২০১১ সালে ৮ হাজার ১০০ কোটি ডলারের ঋণ খেলাপি হওয়ার পর আর্জেন্টিনা তার পাওনাদারদেরকে ওই ঋণের এক-তৃতীয়াংশ পরিশোধের প্রতিশ্রুতি দেয়। কারণ ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তাদের ৯৩ শতাংশ ঋণকে শেয়ারে বদল করা হয়েছিল, এবং ২০১৬ সালের আগ পর্যন্ত আর্জেন্টিনা সরকার বাকি থাকা ঋণের ৭৫ শতাংশের ‘ভালচার ফান্ড’ (খেলাপি হতে যাওয়া বন্ড কেনার জন্য তহবিল) ফেরত দিতে পারেনি।
খেলাপি হলে কতটা মূল্য চুকাতে হয়?
খেলাপি হলে ঋণদাতার মূলধন ও আসল অর্থের লোকসান হয়, যেহেতু আংশিক ঋণ বাতিল বা ঋণ পুনর্গঠন করতে হয়। এটা খেলাপি হওয়ার তাৎক্ষণিক মাশুল।
ঋণ আদায়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকায় খেলাপি সরকারগুলো আগে বিদেশি বেসরকারি ঋণদাতাদের ঋণ বাতিল করার চেষ্টায় থাকে।
সরকার ঋণ খেলাপি হলে মূল্যস্ফীতি, বেকারত্ব এবং রাজনৈতিক চাপ বেড়েই চলে।
যেহেতু দেশীয় ব্যাংকগুলো অভ্যন্তরীণ ঋণের বেশিরভাগ অংশ ধারণ করে, সরকার খেলাপি হলে দেশের আর্থিক ব্যবস্থার ওপর অনাস্থা দেখা দেয়। অনাস্থা বা আতঙ্কের কারণে আমানতদাররা অর্থ তুলে নিতে শুরু করলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দেয়।
সেরকম হলে সরকার মূলধনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে, আমানতদারদের একটি নির্দিষ্ট সীমার বেশি অর্থ তুলতে দেয় না।
ব্যাকিং খাতে এ ধরনের সংকট এড়াতে ২০১৫ সালের জুনে গ্রিসে ২০ দিন সব ব্যাংক বন্ধ রাখা হয়েছিল, বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ ছিল তখন। কেউ দিনে ৫০ ইউরোর বেশি ব্যাংক থেকে তুলতে পারতেন না।
বিদেশি বাজারগুলো কোনো দেশের মুদ্রার ওপর আস্থা হারালে এবং সেই দেশ স্বার্বভৌম ঋণ সংকটে থাকলে সামগ্রিক পরিস্থিতি তাদের আর্থিক ও মুদ্রা সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ঋণ খেলাপি দেশের জন্য আরেকটি বিপদ হল আন্তর্জাতিক বাজারে ঋণ পাওয়া কঠিন হয়ে যায়। নতুন করে ঋণ নিতে গেলে তাদের জন্য চড়া সুদে ধার্য হয়। খেলাপি দেশের ক্রেডিট রেটিং কমে যায়, যা সেদেশে বিদেশি বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করে।