ইসরায়েলের সঙ্গে আমিরাত-বাহরাইনের চুক্তির লাভক্ষতির হিসাব
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে যুক্তরাষ্ট্র তথা ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা কথিত ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করবেন। সেখানে উপস্থিত থাকবেন বাহরাইনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। গত সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত বাহরাইন-ইসরায়েল শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন তিনি।
প্রথম উপসাগরীয় দেশ হিসেবে এক মাসে আগে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিয়েছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। এক মাস না পেরোতেই উপসাগরীয় দ্বিতীয় দেশ এবং মিসর, জর্ডান ও আমিরাতের পর আরব বিশ্বের চতুর্থ দেশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয় বাহরাইন।
অথচ দশকের পর দশক ধরে আরব দেশগুলো ইসরায়েলকে বয়কট করে আসছিল। ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান হলেই কেবল ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন হতে পারে, এমন ইঙ্গিত ছিল এসব দেশের। আসুন দেখে নেয়া যাক যে পাঁচ কারণে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে চুক্তি করছে এই দুই দেশ।
১. উপসাগরীয় দেশ দুটি বাণিজ্যসহ আরও কিছু সুবিধা দেখতে পাচ্ছে
এই চুক্তি উচ্চাভিলাষী আমিরাতিদের সহায়তা করবে; যারা নিজেদেরকে সামরিক শক্তিতে আরও সমর্থ করে গড়ে তোলার পাশাপাশি ব্যবসা করার কিংবা অবকাশ যাপনের জায়গা তৈরি করছে।
দেখে মনে হচ্ছে, আমেরিকানরা উন্নত অস্ত্র বিক্রির প্রতিশ্রুতি দেয়ার মাধ্যমে এই চুক্তি সম্পন্ন করতে সহায়তা করেছে। ফলে সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো কিনতে পারবে। এর মধ্যে রয়েছে এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান ছাড়াও ইএ-১৮ জি গ্রোলারের মতো অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ইতোমধ্যে লিবিয়া এবং ইয়েমেনে তাদের আধুনিক সমরসজ্জিত সশস্ত্র বাহিনীকে ব্যবহার করেছে। কিন্তু তাদের সম্ভাব্য সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের অবস্থান উপসাগরের ঠিক ওপারে।
ইরানের প্রতি আমিরাতের যে বিশ্বাসহীনতা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলেরও একই রকম। একই অবস্থা বাহরাইনেরও। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত ইরান তো বাহরাইনকে নিজেদের অঞ্চল বলে দাবি করতো। বাহরাইনের সুন্নি শাসকরাও দেশের শিয়া সম্প্রদায়কে শত্রু ইরানের পক্ষের শক্তি জেনে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।
উপসাগরীয় এই দুই দেশ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য চুক্তিতে উপনীত হয়েছে। তারা এখন মুক্ত বাণিজ্যের জন্য উন্মুখ। এ ছাড়া বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশের একটি ইসরায়েল।
স্বাভাবিক সময়ে অবকাশযাপনের জন্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মরুভূমি, সৈকত আর শপিং মলগুলো ইসরায়েলের মানুষদের জন্য অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন স্থান। ফলে ব্যাবসার বড় সুযোগ দেখছে দেশ দুটি।
২. আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতা কমে যাবে ইসরায়েলের
চুক্তিতে ইসরায়েলের প্রাপ্তি গুরুত্বপূর্ণ।। আমিরাত এবং বাহরাইনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ইসরায়েলের জন্য একটি প্রকৃত অর্জন। ১৯২০ এর এর দশকে প্রথম বর্ণিত ইহুদি রাষ্ট্র এবং আরবদের মধ্যে একটি ‘আয়রন ওয়াল’ নামক কৌশলটিতে বিশ্বাসী ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু।
আয়রন ওয়াল নামের এই ধারণাগত কৌশলের অর্থ হলো, ইসরায়েল আরব দেশগুলোকে এটা উপলব্ধি করতে বাধ্য করাবে যে, ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়া ছাড়া আরবদের হাতে আরও কোনো উপায় নেই।
মধ্যপ্রাচ্যে বিচ্ছিন্ন থাকতে চায় না ইসরায়েল। মিসর ও জর্ডানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলেও তা কখনও উষ্ণ হয়নি। ফলে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে আরও ভালো সম্পর্ক নিয়ে আশাবাদী তারা।
এ ছাড়া ইরানবিরোধী একটি জোট গঠন করা ইসরায়েলের জন্য আরেকটি বড় প্লাস পয়েন্ট। ইরানকে ইসরায়েলের এক নম্বর শত্রু মনে করেন নেতানিয়াহ, এক সময় ইহুদিরা যেভাবে নাৎসিদেরকে নিজেদের এক শত্রু বলে মনে করবো। তিনি আমিরাতের সঙ্গে সম্ভাব্য অস্ত্র চুক্তিও নিয়ে অভিযোগ নিয়েও এখন নীরব।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এখন একটি দুর্নীতির মামলা চলছে, যা তাকে কারাগারেও পাঠাতে পারে। করোনা মহামারি মোকাবিলা নিয়ে প্রথমে ভালো করলেও পরিস্থিতি এখন খারাপ। কয়েক সপ্তাহ ধরে জেরুজালেমে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের বাইরে নেতানিয়াহুর পদত্যাগ দাবিতে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ করছেন।
ঠিক এ রকম একটি সময়ে হোয়াইট হাউসে দুই উপসগরীয় দেশের সঙ্গে চুক্তি সইয়েরর ব্যাপারটি তাই তার জন্য আশীর্বাদও বলা যেতে পারে। চুক্তি সইয়ের জন্য নেতানিয়াহুর কাছে এর চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না।
৩.পররাষ্ট্রনীতিতে অভ্যুত্থানের উদযাপন করছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প
ট্রাম্পের জন্য এই চুক্তি বেশ কিছু দিক দিয়ে কাজের। এতে করে সবচেয়ে বেশি যেটা কাজের হয়েছে তা হলো আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইরানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগের কৌশল আরও জোরালো হওয়া, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক প্রাক্কালে। ট্রাম্প এখন প্রচার চালাচ্ছেন যে, তিনিই বিশ্বের সেরা ‘ডিলমেকার’।
এ ছাড়া ইসরায়েলের জন্য কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সরকারের লাভ হয় এমন কিছু করলে আমেরিকার কট্টর খিস্টান ধর্মাবলম্বী ভোটারদের ভোট পেতে সুবিধা হবে তার। কেননা আসন্ন মার্কিন নির্বাচনের ইলেকটোরাল কলেজের ভিত্তি তৈরি মাধ্যমে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের জন্য এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
‘আমেরিকার বন্ধু’ ইসরায়েলের সঙ্গে ইরানবিরোধী জোটে যোগ দেয়া উপসাগরীয় দেশগুলো যদি ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকের ক্ষেত্রে অন্তর্মুখী না থেকে আরও খোলাখুলিভাবে তাতে সক্রিয় হয় তাহলে অঞ্চলটিতে মার্কিন স্বার্থ এবং আধিপত্য বাড়বে; ভালোভাবে মোকাবিলা করা যাবে বিরোধী পক্ষগুলোকে।
৪. বিশ্বাসঘাতকতার শিকার ফিলিস্তিনিরা
সবার স্বার্থ থাকলেও ফের বঞ্চিত ফিলিস্তিন। তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন হলো আরও ক্ষীণ। যে আরবদের সহযোগিতায় তারা রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখছিল তারাই ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। বাহরাইন-আমিরাতের চুক্তিকে বিশ্বাসঘাতকতা অভিহিত করে ফিলিস্তিন বলছে, এটা আমাদের পিঠে ছুরিকাঘাত।
ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে চলেছে ইসরায়েলে। ইসরায়েলি দখলে জিম্মি তাদের পুর্ব জেরুজালেম এবং পশ্চিম তীর। আর গাজাও হয়ে গেছে উন্মুক্ত এক কারাগার। এর মধ্যে আরব দেশগুলো একের পর এক ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে। সামনে সৌদি ছাড়াও আরও আরব দেশ এই তালিকায় যুক্ত হতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডি-ফ্যাক্টো নেতা এবং আবুধাবির ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ান অবশ্য বলেছেন, পশ্চিম তীরে বিশাল এলাকায় ইসরায়েলি দখল থামানোর প্রতিশ্রুতিতে তিনি চুক্তি করেছেন। কিন্তু বাস্তবে তার কতটা প্রতিফলন ঘটবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। অন্তত অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে।
৫. কৌশলগতভাবে ইরানের নতুন মাথাব্যথা
আমিরাত এবং বাহরাইন— উভয় দেশের সঙ্গে ইসরায়েলের চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে এর প্রতিবাদ করেছে ইরান। শুধু মুখে মুখে নয় তারা জোরালো গলায় অনেক কথা তুলেছে। এমনিতেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ইরানের অর্থনীতির অবস্থা নাজেহাল তার ওপর এই চুক্তি দেশটির জন্য নতুন করে মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলের সামরিক ঘাঁটিগুলো থেকে ইরানের দূরত্ব অনেক বেশি। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাতের অবস্থান ঠিক সাগরের ওপারে। এটাই উল্লেখ করার মতো এবং ইরানের জন্য উদ্বেগজনক হয়ে উঠতে পারে যদি ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইরান বিরোধী এই জোট হামলা করার পরিকল্পনা করে।