ইউরোপের রপ্তানিযোগ্য টালি শিল্পে ধ্বস কলারোয়ায় প্রায় ৫ হাজার শ্রমিকের মানবতের জীবন
কলারোয়া (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি
সাতক্ষীরার কলারোয়ায় ইউরোপের রপ্তানিযোগ্য অর্ধশত টালি কারখানা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। সহজশর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়াসহ নানা কারনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাময় এই টালি শিল্প মুখথুবড়ে পড়েছে। অধিকাংশ কারখানায় উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। ফলে টালি শিল্পের সাথে জড়িত প্রায় ৫ হাজার শ্রমিক মানবেতর জীবনযাপন করছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সম্ভাবনাময় এই শিল্প অচিরেই ধবংস হয়ে যাবে বলে মনে করেন এখানকার টালি শিল্পের মালিক ও শ্রমিকেরা।
এলাকা পরিদর্শন করে জানা গেছে, বিগত ২০০০ সালে সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার মূরালিকাটি পালপাড়া এলাকায় প্রথম শুরু হয় বিদেশে রপ্তানিযোগ্য বিভিন্ন প্রকারের টালি উৎপাদন। শুরুতেই ৫টি কারখানায় উৎপাদিত টালি ইটালিতে রপ্তানি শুরু করে এখানকার টালি কারখানা মালিকেরা। সে কারনে এই এলাকাটি ‘ইটালী নগর’ হিসিবে পরিচিতি লাভ করে। ২ বছর যেতে না যেতেই এখানকার উৎপাদিত টালি নজর কাড়ে বেশ কয়েকটি দেশে। একে একে দুবাই, ইউরোপ, মালেশিয়া, দক্ষিণ আফরিকা, নেদারল্যান্ড ও আমেরিকায় জাহাজে করে রপ্তানি শুরু হয় এখানে উৎপাদিত নানা প্রকার টালি। চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে এই এলাকায় টালি কারখানার সংখ্যাও বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রায় ৫০টি টালি কারখানা গড়ে উঠেছে। যা কারখানা গুলো কলারোয়ার মূরারিকাটি, শ্রীপতিপুর ও মির্জাপুর এলাকায়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫ হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয় এই কারখানা গুলোতে।
কলারোয়া টালি কারখানা মালিক ব্যবসায়ি সমবয় সমিতির সভাপতি গোষ্ট চন্দ্র পাল জানান, ২০১০ সাল পর্যন্ত টালি শিল্প মালিকরা আন্তর্জাতিক বাজারে বেশ ভালই দাম পেয়েছে। প্রতিটি টালি ৩০ থেকে ৬০ টাকা হারে বিক্রি করেছে তারা। প্রতিবছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় এই শিল্প থেকে। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে এই শিল্পে ধ্বস নামতে শুরু করে। স্থানীয় টালি কারখানা মালিকদের মধ্যে অনৈক, নিজেদের মধ্যে রেসারেসি, বেঁচা-বিক্রির অসমপ্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই সুযোগ লুফেনেয় বিদেশি বায়াররা। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে টালির দাম কমতে শুরু করে, অথচ দিন দিন উৎপাদন খরচ বাড়তে থাকে। যে টালি আগে ৬০ টাকায় বিক্রি হতো, বর্তমানে তার দাম কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৮ থেকে ১০ টাকায়। বর্তমানে যে দামে বিক্রি হচ্ছে তার চেয়ে উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে। লোকশানের কারনে অর্ধেকেরও বেশি টালি কারখানা বর্তমানে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ৪ থেকে ৫ কোটি টাকার টালি রপ্তানি হচ্ছে। কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েক হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে।
টালি খারখানা মালিক ব্যবসায়ি সমবয় সমিতির সমিতির সাধারণ সম্পাদক পৌর কাউন্সিলর শেখ ইমাদুল ইসলাম ইমাদ জানান, শহজশর্তে ব্যাংক ঋণ না পাওয়া, আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে সরকারি সহযোগিতা না পাওয়া, আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার না হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। উৎপাদন বিক্রি মূল্যের চেয়ে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের লোকশান হচ্ছে। এসব কারনে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সম্ভাবনাময় এই টালি শিল্প আজ মুখথুবড়ে পড়ছে।
এ গ্রামের টালি কাখনার মালিক আবুল হোসেন জানান, কলারোয়া পৌরসভার অন্তর্গত মুরারীকাটি গ্রামের মানুষ বসবাস করতো নানা কষ্টের মধ্যে। বেকার সমস্যা ছিলো এ গ্রামের মানুষের প্রধান অন্তরায়। কিন্ত রফতানিজাত টালি কারখানার কারণে এ গ্রামের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘাটয়েছে। এ গ্রামের টালি শিল্প এখন এ অঞ্চলের ৯০ শতাংশ মানুষের কর্মসংস্থান করে দিয়েছে।
নারী শ্রমিক আলেয়া খাতুন এবং শ্রমিক পলাশ হোসেন জানান, এলাকায় কৃষি কাজ ছাড়া তেমন কোনো কাজ মিলতো না এ গ্রামে। টালি কারখানা হওয়ার পর থেকে তারা টালি তৈরির কাজ করে দৈনিক আয় করছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। তাই নিজ গ্রামে এসব টালি কারখানা হওয়ায় বেকারত্ব ঘুচেছে তাদের।
এ বিষয়ে কলারোয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফিরোজ আহমেদ স্বপন জানান, সহজশর্তে সরকারি ঋণ সহায়তা, জরুরী ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার সৃষ্টিতে সরকারি উদ্যোগ গ্রহণ করা এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদিত টালির মান নিশ্চিত করা গেলে সম্ভবনাময় এই শিল্প থেকে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব হবে। সরকার এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করবে এমনটিই প্রত্যাশা করছে টালি ব্যবসায়ী সমিতির নেতৃবৃন্দ।