ইউনাইটেড হাসপাতালে আগুন : ফায়ার সার্ভিসের তদন্তে যা উঠে আসল
রাজধানী গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে এসি বিস্ফোরণে লাগা আগুনে চিকিৎসাধীন রোগীসহ ৫ জনের প্রাণহানির ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ‘অবহেলার’ প্রমাণ পেয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের তদন্ত কমিটি। এছাড়াও হাসপাতালটির করোনা ইউনিট ও এর আশপাশে অগ্নিনির্বাপণের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকার বিষয়টিও উঠে এসেছে তদন্ত প্রতিবেদনে। আগামী ২-১ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে ফায়ার সার্ভিস।
শনিবার (৬ জুন) ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত কমিটি সূত্র জানায়, নিহত ৫ জনের পরিবারের সদস্য, প্রত্যক্ষদর্শী, ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটের কর্তব্যরত চিকিৎসক-নার্স, সিকিউরিটি গার্ড ও বিদ্যুৎ বিভাগের মোট ২০ জনের জবানবন্দি নেয়া হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপ-পরিচালক ও গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘তদন্তে আমরা ইউনাইটেড হাসপাতালের কিছু অবহেলা পেয়েছি। তাদের কিছু উদাসীনতা ছিল। সেগুলো রিপোর্টে লেখা থাকবে। এছাড়াও তাদের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার খুঁটিনাটি, হাসপাতালে কি ছিল, কি ছিল না সেগুলো উঠে আসবে।’
এদিকে আগুন লাগার পর ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছিল যে, বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিস বিদ্যুৎ বিভাগের যেসব কর্মকর্তার জবানবন্দী নিয়েছে তাদের কেউই শর্ট সার্কিট থেকে আগুন লাগার প্রমাণ পায়নি। এছাড়াও প্রায় সব প্রত্যক্ষদর্শী আগুনের আগে এসি থেকে ধোয়া বের হতে দেখেছেন বলে জবানবন্দিতে জানিয়েছেন। তদন্ত রিপোর্টে ‘এসি থেকেই আগুনের সূত্রপাত’ হয়েছে বলে উল্লেখ করা হতে পারে।
দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘২-১ দিনের মধ্যেই মন্ত্রণালয়ে রিপোর্ট জমা দেয়া হবে। এতে আগুন লাগার সুনির্দিষ্ট কারণ তুলে ধরা হবে। পুরনো একটি এসি থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। রিপোর্টে এ বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে, পাশাপাশি ইউনাইটেডের জন্য করনীয় ও বেশ কয়েকটি সুপারিশ থাকবে।’
ঘটনাটি সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, ইউনাইটেডের আইসোলেশন ইউনিটে উচ্চমাত্রার ঝুঁকি ছিল। নতুন আইসোলেশন ইউনিটের কোনো ফায়ার সেফটি সনদ ছিল না। এর পার্টিশনগুলো পারটেক্স জাতীয় হ্যান্ড স্যানিটাইজার, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ অতিমাত্রায় দাহ্য পদার্থ ছিল। আগুন লাগার পর সেখানকার দায়িত্বরত কর্মকর্তারা নিজের প্রাণ বাঁচাতে সবাই বেরিয়ে যান। একজন কর্মকর্তাকে পানির মগ দিয়ে আগুনের দিকে পানি ছিটাতে দেখা যায়। প্রথমে কেউই এগিয়ে আসেনি। এছাড়াও ইউনিটের আশপাশে ফায়ার স্টিংগুয়েশার ছিল না, এমনকি তার পাশের গার্ড রুমেও কোনো অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল না।
ফায়ার সার্ভিসকে ডাকতে মিনিট বিলম্ব
আগুনের বিষয়ে ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, হাসপাতালে আগুনের সূত্রপাত হয় বুধবার রাত ৯টা ৩০ মিনিটে। আর ফায়ার সার্ভিস বলছে, তাদের কাছে আগুনের সংবাদ আসে ৯টা ৫৫ মিনিটে। ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে ২৫ মিনিট কেন সময় লেগেছিল? ফোন দেয়া কার দায়িত্ব ছিল, আর এই ২৫ মিনিটে কেন আগুন নেভানো যায়নি? এসব বিষয় উঠে আসবে ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদনে।
এর আগে, গত ২৭ মে ইউনাইটেড হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে (মূল ভবনের বাইরে স্থাপিত) আগুন লাগে। এ ঘটনায় পাঁচজনের মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস। যাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে তারা হলেন- রিয়াজুল আলম (৪৫), খাদেজা বেগম (৭০), ভের্নন এন্থনি পল (৭৪), মো. মনির হোসেন (৭৫) ও মো. মাহাবুব (৫০)। তাদের মধ্যে একজন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন, বাকিরা আইসোলেশন ইউনিটে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে ভর্তি ছিলেন।
এ ঘটনায় ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি অপমৃত্যুর মামলা করলেও আগুনে নিহত ভের্নন এন্থনি পলের পরিবারের পক্ষ থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে একটি ‘অবহেলাজনিত মৃত্যুর’ মামলা করা হয়েছে। মামলায় ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও, পরিচালক, করোনা ইউনিটে সে সময় কর্মরত ডাক্তার-নার্স, সেফটি ও সিকিউরিটি কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়েছে।
এ ঘটনায় পুলিশেরও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কমিটির একজন সদস্য বলেন, ‘এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ২৫ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। এছাড়াও একজন নিহতের স্বজনের মামলার বিষয়টিও তদন্ত করা হচ্ছে। শিগগিরই প্রতিবেদন জমা দিতে পারব বলে আশা করছি।’
এদিকে, অগ্নিকাণ্ডে চিকিৎসাধীন রোগীসহ ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হাসপাতালের লাইসেন্স বাতিল চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার রেদোয়ান আহমেদ রানজীব ও ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ হাইকোর্টে রিট করেছেন।