ইউনাইটেডের শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা: পুলিশ
গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডে পাঁচ রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় ঢাকার ওই বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের শীর্ষ কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এ ঘটনায় নিহত এক রোগীর স্বজন ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান, এমডি, সিইও, পরিচালক, সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক-নার্স ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ কাজের কারণে রোগীদের মৃত্যুর অভিযোগ এনে গুলশান থানায় একটি মামলা দায়ের করেন।
মামলা তদন্তের অগ্রগতি জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী উপ-কমিশনার মো. রফিকুল ইসলাম বুধবার বলেন, “তদন্ত করছি। এতদিন আগুনের ঘটনায় একটি তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে আদালতে জমা দিয়েছি। এখন অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যুর অভিযোগে যে মামলা সেটার তদন্ত করব।”
যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের কেন গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অভিযোগকারী তো অনেকের পদ উল্লেখ করেছেন, কিন্তু সবাইতো আর অপরাধী নয়। তদন্ত করে আরও নিশ্চিত হতে হবে যে, ওই ঘটনার জন্য আসলে কে দায়ী?”
তদন্তে যার-ই অপরাধ পাওয়া যাবে তাকেই গ্রেপ্তার করা হবে জানিয়ে পুলিশের গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেছেন, “প্রভাবশালী বলে কাউকে রেহাই দেওয়া হবে না, অপরাধ ও দায়িত্বে অবহেলা করলে আইনের মুখোমুখি হতে হবে।”
ততক্ষণে আসামিরা দেশত্যাগ করলে কী করবেন জানতে চাইলে গুলশান পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তা সুদীপ বলেন, “তা পারবে না। সবার নিষেধাজ্ঞা দেওয়া আছে। কেউ কোথাও যেতে পারবেন না।”
সম্প্রতি এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের অপহরণ ও অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে হত্যার হুমকি দেওয়ার অভিযোগে মামলা হওয়ার পর ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালক রন হক সিকদার ও তার ভাই দিপু হক সিকদার এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ব্যাংককে পালিয়ে যান।
ওই ঘটনা মাথায় রেখেই ইউনাইটেড হাসপাতালের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
কার কার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম বলেন, “ইউনাইটেড হাসপাতালের শীর্ষ পর্যায়ের ৫-৬ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।”
ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান পদে আছেন হাসান মাহমুদ রাজা। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে আছেন ফরিদুর রহমান খান।
করোনাভাইরাস রোগীদের জন্য হাসপাতাল ভবনের সামনে তাঁবু টাঙিয়ে অস্থায়ী একটি ইউনিট করেছিল ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ। গত ২৭ মে রাত পৌনে ১০টার দিকে ওই আইসোলেশন ইউনিটে আগুন লেগে ভারনন এ্যান্থনী (৭৪), মো. মাহবুব (৫০), মো. মনির হোসেন (৭৫), খোদেজা বেগম (৭০) ও রিয়াজ উল আলম (৪৫) নামে পাঁচজন মারা যান। এদের মধ্যে তিনজন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ছিলেন।
ভারনন এ্যান্থনীর জামাতা রোনাল্ড মিকি গোমেজ ৩ জুন গুলশান থানায় ওই মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার দুই সপ্তাহ পরেও পুলিশ কোনো অগ্রগতির খবর না দেওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন রোনাল্ড মিকি গোমেজ।
তিনি বুধবার বলেন, “মানসিকভাবে আমরা সবাই ভেঙ্গে পড়েছি। আমার চোখের সামনেই সব ঘটনা ঘটল। শ্বশুর যে বেডে ছিল সেই বেড মুভ করা যায়, কিন্তু আগুন লাগার পর কেউ আমাকেও সহযোগিতা করল না আর মুভ করা বেডগুলো কেউ টেনে বের করার চেষ্টাও করলো না।
“কী বলব খুবই দুঃখজনক, হতাশাজনক ঘটনা!
রোনাল্ড বলেন, “ইউনিটের এসিতে প্রথমে সামান্য আগুন লাগলে সবাইকে বললাম অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আনতে। কিন্তু ওয়ার্ড বয় বলল, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নাই। সে দৌঁড়ে গিয়ে আনল ফ্লোর মোছার মপ, যা দিয়ে চেষ্টা করতে গিয়ে আগুন আরও বেড়ে গেল।”
ঝুঁকিপূর্ণ ও নিম্নমানের তাঁবু ব্যবহারের ফলে আগুন লাগার মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে করোনা ইউনিট ভস্মীভূত হয় বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে।
এই ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ন্যায়বিচারের জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টার আশ্বাস দিয়ে গুলশান পুলিশের উপ-কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, “এখানে তদন্তে কোনো ধরনের গাফিলতি নাই। আসামি প্রভাবশালী কি না তাও দেখছি না।”এখনও কাউকে গ্রেপ্তার না করার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “বড় বড় ঘটনা যেমন রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় রানার সরাসরি সংশ্লিষ্টা পাওয়া গেছে। এছাড়া অন্য ঘটনাগুলোও তাই। এখানেও একটা আগুনের ঘট্না ঘটেছে। পুলিশ ইতোমধ্যে তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন আদালতে জমা দিয়েছে। সেখানে ৩৮ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। পুঙ্খানুপুঙ্খ অনেক কিছু বের করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, “পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে সব কিছু উঠে এসেছে, যা মামলার তদন্তে অনেক কাজে দেবে এবং কার কার অবহেলায় এই ঘটনা ঘটেছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।”
তদন্ত প্রতিবেদন নিয়ে সুদীপ কুমার চক্রবর্তী আগেই বলেছিলেন, “হাসপাতাল কম্পাউন্ডে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য তাঁবু টানিয়ে যে অস্থায়ী ইউনিট স্থাপন করা হয় সেটি অগ্নি-প্রতিরোধক ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ ও নিম্নমানের তাঁবু ব্যবহারের ফলে আগুন লাগার মাত্র দেড় মিনিটের মধ্যে করোনা ইউনিটগুলো ভস্মীভূত হয়।
“ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সংযোগের কারণে ব্যবহার অযোগ্য পুরনো একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে প্রথম অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুন লাগার পর অস্থায়ী ওই ইউনিটে দায়িত্বরত চিকিৎসক ও নার্সরা নেভানোর চেষ্ট না করে দ্রুত পালিয়ে যান। তবে আরাফাত নামে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী আগুন নেভানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন।”
হাসপাতালের ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) পর্যালোচনা করে অগ্নিকাণ্ডের সময় কার কী ভূমিকা ছিল, সে বিষয়ে পুলিশের তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে বলে জানান তিনি।
“তদন্ত করে যখন কে কে অপরাধ করেছেন, দায়িত্ব অবহেলা কে করেছেন, ঠিকমত দায়িত্ব পালন করেননি- এসব বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হবে তখনই তাকে গ্রেপ্তার করা হবে,” বলেন উপ-কমিশনার সুদীপ।