ইউক্রেন জয়ী হলে আমেরিকার কী লাভ?
যুদ্ধ নাকি ধর্মনিরপেক্ষ ইতিহাসের মাইলফলক, বলেছিলেন উইনস্টন চার্চিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন একটি বিপজ্জনক যুগের সূচনা করে যা পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে চিহ্নিত করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন অস্ত্র, নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ইউক্রেনকে রাশিয়ার আগ্রাসন প্রতিহত করতে কাজ করছেন। ২০২৩ সালে বাইডেনকে একটি আসন্ন জয়ের জটিলতার মুখোমুখি এবং বিপজ্জনক লড়াই করতে হতে পারে। দ্য ইকোনমিস্টের বিশ্লেষণে চিত্রায়িত হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের চলমান সম্পর্কের সমীকরণ।
বাইডেন বিশ্বকে নতুন আকার দিতে দৃঢ়সংকল্প নিয়েছেন যেটিকে তিনি অভিহিত করছেন ‘নির্ণায়ক দশক’ হিসেবে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্যান্য দ্বন্দ্বও উদ্বেগের বিষয়। চীন তাইওয়ান আক্রমণ করলে বাইডেন ব্যবস্থা নেবেন বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রে সক্ষমতা অর্জন করতে দেবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যদিও ইরান এতে পিছু হঁটছে না। উত্তর কোরিয়ার এরইমধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, এবং সেগুলো সরবরাহ করার জন্য তার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা জোরদার করছে। এটি আমেরিকা ও দক্ষিণ কোরিয়াকে সামরিক মহড়া বাড়াতে প্ররোচিত করেছে এবং আকস্মিক যুদ্ধের ঝুঁকিও বাড়াচ্ছে।
এটি এমন বিশ্ব নয় যা প্রেসিডেন্ট বাইডেন মোকাবিলা করবেন বলে আশা করেছিলেন। তিনি আমেরিকার অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বাড়াতে, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক ইস্যুর সমাধান, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসা, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্থিতিশীল এবং তার আগে অন্যদের মতো এশিয়াতে অবস্থান শক্ত করার লক্ষ্য নিয়ে ক্ষমতায় বসেছিলেন। যদিও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আমেরিকাকে ইউরোপে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন।
বাইডেন পুনরায় আবিষ্কার করেন আমেরিকা, বিশ্বের প্রধান শক্তি হিসাবে, তার মনোযোগ রয়েছে। গত অক্টোবরে প্রকাশিত বাইডেনের জাতীয়-নিরাপত্তা কৌশল অনুসারে বিশ্বের এক অংশে বিশৃঙ্খলা আমেরিকাকে অন্যত্র দুর্বল করে। তাই তিনি আশাবাদী ইউক্রেনে সাফল্য লাভ করা নিয়ে কেননা রাশিয়ার সক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। অপরদিকে, ন্যাটো শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। ইউরোপ আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আমেরিকান শক্তি সর্বত্র স্বৈরাচারীদের একটি বার্তা দিতে পেরেছে।
তবে প্রথমে ইউক্রেনকে জয়ী হতে হবে। বাইডেনকে ঘর এবং বাহির উভয় এক সঙ্গে সমন্বয় করে রাখতে হবে। ইউরোপে এই শীতে জ্বালানি সংকট আরও তীব্র হতে পারে। আমেরিকায় রিপাবলিকানরা প্রতিনিধি পরিষদের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। আমেরিকার কট্টরপন্থিরা ইউক্রেনের প্রতি বিদ্বেষী বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইউক্রেনকে কয়েক বিলিয়ন ডলার সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখা কঠিন হয়ে ওঠতে পারে।
যদি ধরে নেই, ইউক্রেন ২০২৩ সালে প্রতিরোধ যুদ্ধে এগিয়ে থাকবে। তবে একটি আসন্ন জয় নতুন সমস্যার উত্থাপন ঘটাবে, যার মধ্যে প্রধান হলো পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার। ইউক্রেন রাশিয়াকে পরাজিত করার যত কাছে আসবে, পরমাণু অস্ত্রের প্রলোভন ততই শক্তিশালী হবে। তীরে এসে পুতিন কী করবেন সেটা কেউ জানে না।
ইউক্রেন জয়ী হলে আমেরিকার কী লাভ?
প্রেসিডেন্ট পুতিন কূটনৈতিকভাবে সমস্যা সমাধানে তার লাভ খোঁজার চেষ্টা করলেও ইউক্রেন সেসবের কিছুই মেনে নেওয়ার মুডে নেই। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্বাধীন হয় ইউক্রেন। সেই নীতি অনুযায়ী সম্পূর্ণ রাশিয়ান সেনা প্রত্যাহারের পাশাপাশি ক্ষতিপূরণ ও যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় দেশটি। যদিও ইউরোপের তাদের কিছু মিত্র এ ধরনের দাবি নিয়ে উদ্বিগ্ন। ইউক্রেনের এমন দাবিতে বাইডেন তার হাত বাড়াননি, তবে দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক হিসাবে, লড়াই কখন বন্ধ করা উচিত এবং কী শর্তে সে সম্পর্কে তার একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য থাকবে।
যেকোনো চুক্তি স্থায়ী শান্তির পরিবর্তে ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি হতে পারে। ন্যাটো ও ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইউক্রেনের ফাস্ট-ট্র্যাক সদস্যপদ গ্রহণের অনুরোধ গ্রহণ করবে কিনা তারা। যদিও দেশটির সাহসিকতা পশ্চিমের অস্বীকার করাকে কঠিন করে তুলবে। কিন্তু ন্যাটোর সদস্য হলে আমেরিকা তার পারমাণবিক ছাতা ইউক্রেনে প্রসারিত করবে। এটি কি শান্তি রক্ষা করতে সাহায্য করবে, নাকি রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়াবে সেটিই দেখার বিষয়।
বাইডেন প্রশাসন মনে করে রাশিয়া ‘বর্তমান ও অনবরত হুমকি’। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো চীন। যেটি বিশ্বকে নতুন আকার দেওয়ার অভিপ্রায় পোষণ করে এবং ক্রমাগত আধিপত্য বিস্তার করছে। একদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে ‘প্রক্সি যুদ্ধ’ এবং অন্যদিকে, বাইডেনের চীনের সঙ্গে ‘চিপ যুদ্ধ’। চীনের দ্রুত সামরিক সক্ষমতা বাড়ানো এবং আশঙ্কা রয়েছে আগামীতে তাইওয়ান আক্রমণের। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, ইউক্রেন যুদ্ধ একটি ‘বিভ্রান্তি’।
বাইডেন প্রশাসনের বক্তব্য হলো এটি মিত্রদের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেটওয়ার্কের জন্য রাশিয়া ও চীন উভয়কেই প্রতিহত করতে পারে। সামরিকভাবে, ইউরোপে মিত্রদের রক্ষা করা দেশটির সেনাবাহিনীর জন্য একটি প্রধান কাজ, যেখানে এশিয়ায় তাদের সমর্থন করার জন্য বিমান ও নৌ শক্তি বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু সামরিক বাজেট, এমনকি আমেরিকার মতো বড় দেশেও সবসময় সীমাবদ্ধ থাকে।
মধ্যবর্তী মেয়াদে রিপাবলিকানদের নেতৃত্বের ফলে আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী তহবিল বৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে। ইউক্রেনের সাফল্য আমেরিকার ভূ-রাজনৈতিক দ্বিধান্বিত সংকটও দূর করতে পারে। এমনকি নক-আউটের পরিবর্তে রাশিয়ার বিরুদ্ধে একটি পয়েন্টে জয় চীনকে বোঝানোর জন্য যথেষ্ট হতে পারে যে তাইওয়ানকে নিয়ে জুয়া খেলা নয়।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট