অস্ট্রেলিয়ায় লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় ফেরানো কে এই আলবানিজ?
এক দশকেরও বেশি সময় পর লেবার পার্টিকে নির্বাচনে জিতিয়ে ক্ষমতায় ফেরানো অ্যান্থনি আলবানিজই অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন।
দেশটিতে যে অল্প ক’জন দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করছেন, আলবানিজ তাদের অন্যতম। ২০১৩ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা রক্ষণশীল লিবারেল-ন্যাশনাল জোটকে সরিয়ে দিতে কাজ করা এ রাজনীতিক ভোটারদেরকে ‘নিরাপদ পরিবর্তনের’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।
ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন নিজেই নিজেকে ‘বুলডোজার’ বলেছিলেন; তার বিপরীতে আলবানিজের অঙ্গীকার ‘নির্মাতা’ হওয়ার।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, কোভিড মহামারীতে অস্ট্রেলিয়ার রাজ্যগুলো একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, কঠোর লকডাউনের কারণে শহরগুলোও আলাদা আলাদা খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল; এই পরিস্থিতিতে দেশবাসীর ঐক্য মজবুত করাই এখন নতুন প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার তালিকার শীর্ষে স্থান করে নিয়েছে।
“আমি অস্ট্রেলিয়ানদের এক জায়গায় নিয়ে আসতে চাই। আমি আমাদের অভিন্ন উদ্দেশ্য খুঁজে বের করতে চাই, আতঙ্ক ও বিভেদ নয়, ঐক্য ও আশাবাদকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাই,” শনিবার রাতে বিজয়ীর ভাষণে বলেন আলবানিজ।
কে এই আলবো?
অস্ট্রেলিয়ায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা টিকিয়ে রাখার পক্ষের যোদ্ধা হিসেবে খ্যাতি অর্জন করা আলবানিজ সমকামী সম্প্রদায়ের সমর্থক, একজন প্রজাতন্ত্রী ও রাগবি লীগ অনুরাগী।
আলবো নামে পরিচিত ৫৯ বছর বয়সী এ রাজনীতিক বড় হয়েছেন সোশাল হাউজিংয়ে, শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য থাকা পেনসনের ওপর নির্ভরশীল মায়ের পরিচর্যায়। এভাবে বড় হওয়াই তার প্রগতিশীল বিশ্বাসের ভিত গড়ে দিয়েছিল বলে এখনও প্রায়ই বলেন এ লেবার নেতা।
ছোটবেলায় আলবানিজের ধারণা ছিল, জন্মের আগেই তার বাবা মারা গেছেন। পরে কৈশোরে জানতে পারেন, ইউরোপ ভ্রমণের সময় এক বিবাহিত পুরুষের সঙ্গে মেলামেশার পর তার মা গর্ভবতী হয়ে পড়েছিলেন।
তারও তিন দশক পর কার্লো আলবানিজের খোঁজ পান; অ্যান্থনি ইতালিতে উড়ে গেলে পিতা-পুত্রের প্রথমবার দেখা হয়। অ্যান্থনি তার সৎ ভাই-বোনদেরও দেখা পান সেখানে।
অ্যান্থনি আলবানিজ বলেছেন, তার মা মেরিঅ্যান এলেরি ছেলের জন্য সেসব সুযোগ নিশ্চিত করতে সঙ্কল্পবদ্ধ ছিলেন, যেগুলো তিনি নিজে পাননি। তার কারণেই আলবো পরিবারের প্রথম সদস্য হিসেবে স্কুল শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছেন।
ছেলে নাথানের জন্য একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ার চিন্তাই তাকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছে বলে ভাষ্য আলবানিজের।
১৯ বছরের দাম্পত্য জীবন শেষে ২০১৯ সালে স্ত্রী কারমেল টেবুটের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয় তার। এখনকার সঙ্গী জোডি হেইডোন নির্বাচনী প্রচারণায়ও তাকে সঙ্গ দিয়েছেন।
২৫ বছরের এমপি
আলবানিজ গত তিন বছর ধরে লেবার পার্টির নেতৃত্বে আছেন; পার্লামেন্টে নির্বাচনে হেরে পূর্বসূরী বিল শর্টেন দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর ২০১৯ সালে তিনি দলের শীর্ষ পদে আসেন।
আলবানিজের বয়স যখন ২০ এর ঘরে ছিল, তখন থেকেই তিনি লেবার পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী। ১৯৯৬ সালে, নিজের ৩৩তম জন্মদিনে সিডনির একটি আসন থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে তিনি সামনের কাতারে চলে আসেন।
২০০৭ সালে কেভিন রুডের হাত ধরে লেবার পার্টি অস্ট্রেলিয়ার ক্ষমতায় এলে আলবানিজ অবকাঠামো ও পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
২০১০ সালে রুডকে সরিয়ে জুলিয়া গিলার্ড লেবার পার্টির দায়িত্ব নেওয়ার পর টালমাটাল পরিস্থিতি তৈরি হলেও আলবানিজের গুরুত্ব কমেনি। ২০১৩ সালে রুড ফের প্রধানমন্ত্রীত্ব পেলে আলবানিজ পদোন্নতি পান, হন উপপ্রধানমন্ত্রী।
তবে লেবার পার্টি নির্বাচনে হেরে যাওয়ায় এই পদে ১০ সপ্তাহের বেশি থাকতে পারেননি তিনি।
আলবানিজ এরপর দলের শীর্ষ নেতা হওয়ার লড়াইয়ে নামেন। নেতাকর্মীদের মধ্যে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও দলের বেশিরভাগ এমপির সমর্থন নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী বিল শর্টেন অস্ট্রেলিয়ার বিরোধীদলীয় নেতার পদ বাগিয়ে নেন।
পরপর দুই নির্বাচনে হারার পর শর্টেন লেবারপ্রধানের পদ হারালে ২০১৯ সালে দলের শীর্ষপদে বসেন আলবানিজ।
অস্ট্রেলিয়ার পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী
দীর্ঘদিন লেবার পার্টির বাম অংশের কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিতি থাকলেও শীর্ষনেতার পদ পাওয়ার পর থেকে আলবানিজ মধ্যপন্থার দিকে ঝুঁকতে শুরু করেন।
২০১৯ সালের নির্বাচনে লেবার পার্টিকে ত্যাগ করা রক্ষণশীল ভোটারদের সমর্থন পেতে এবারের নির্বাচনী প্রচারে আলবানিজকে অনেক ইস্যুতে তার আগের অবস্থান থেকে পিছু হটতে দেখা গেছে।
তিনি জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আরও আগ্রাসী পদক্ষেপ নেওয়ার অবস্থান থেকে সরে এসেছেন, এবং চীন ও জাতীয় নিরাপত্তা প্রশ্নে রক্ষণশীলদের মতোই কট্টর অবস্থান নিয়েছেন।
নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছানো অভিবাসনপ্রত্যাশীদের ফিরিয়ে দেওয়ার বিতর্কিত নীতিতেও এখন তার সমর্থন আছে, যে নীতির বিরুদ্ধে তিনিই একসময় গলা ফাটিয়েছিলেন।
অবশ্য বয়স্ক ও শিশু সেবা এবং উৎপাদন খাতে বেশি ব্যয়ের লেবার নীতি এবং আদিবাসীদের আরও ক্ষমতা দেওয়ার বিষয়ে তিনি এখনও অটল।
শনিবার বিজয়ী ভাষণে নিজের বেড়ে ওঠার কথা উল্লেখ করে কোনো অস্ট্রেলীয় যেন পেছনে পড়ে না থাকে তা নিশ্চিতের অঙ্গীকার করেছেন আলবানিজ।
“শারীরিকভাবে অক্ষমদের জন্য থাকা পেনসনে চলা এক সিঙ্গেল মায়ের ছেলে, যে পাবলিক হাউজিংয়ে বড় হয়েছে, সে আজ রাতে আপনাদের সামনে অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাঁড়াতে পারছে। এটাই আমাদের মহান দেশ সম্পর্কে অনেক কিছু বলে দিচ্ছে।
“আমি চাই, অস্ট্রেলিয়া সেই দেশ হওয়া অব্যাহত রাখুক, যেখানে আপনি কোথায় থাকেন, কাকে পূজা করেন, কাকে ভালোবাসেন বা আপনার শেষ নাম কী, এগুলো আপনার জীবনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না।
“আমি আশা করছি, আমার জীবনের যাত্রা সংগ্রামে অনুপ্রেরণা যোগাবে অস্ট্রেলিয়ানদের,” বলেছেন তিনি।