অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দাবি
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দেওয়ার পাশাপাশি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্ত করা, ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধাদের সনাক্ত করে তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা। গতকাল বুধবার রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ৪৭তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ‘মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশে’ এ দাবি জানানো হয়। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে জেলা ইউনিটের কমান্ডার ও তাদের প্রতিনিধিরা সমাবেশে বক্তব্য দেন।
বঙ্গবন্ধুর ডাকে একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা স্মরণ করে সংগঠনের কুষ্টিয়া জেলা কমান্ডার মানিক কুমার ঘোষ বলেন, সবাই চাকরি থেকে সাবেক হবে, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সাবেক হবে না, এমনকি কোনো মুক্তিযোদ্ধা মারা গেলেও তিনি মুক্তিযোদ্ধা।
মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরে মানিক কুমার ঘোষ বলেন, যারা লাল মুক্তিবার্তাধারী, তারা যে ভাতা পায় অন্যরা তা পায় না। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এই বৈষম্য থাকতে পারে না। সকল মুক্তিযোদ্ধা সমান, সবাই সমান ভাতা পাবেন।
নরসিংদীর জেলা কমান্ডার মনসুর আহমেদ বলেন, আমাদের সংসদ থেকে ১৯ দফা দাবি রয়েছে, এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে গার্ড অব অনার দিয়ে দাফনসহ তিনটি দাবি মানা হয়েছে। আমরা আব্দুল আহাদ চৌধুরীকে আবার মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সভাপতি দেখতে চাই, যাতে অন্যান্য দাবিও আদায় করতে পারি। অবিলম্বে জেলা ও থানায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
ঝিনাইদহ জেলা ইউনিটের কমান্ডার টুলু মিয়া বলেন, নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা যাচাই-বাছাই হচ্ছে, মন্ত্রণালয় থেকে আমার জেলায় ৬০০ থেকে ৭০০ মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে, সেখান হয়ত সাত থেকে আটজন থাকতে পারেন মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
আবার জাতীয় পরিচয়পত্রে বয়স কম থাকার কারণে কিছু ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা’ও স্বীকৃতি পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন তিনি। গত এক বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচিত নেতৃত্ব না থাকায় এবং জেলা কমান্ডের দায়িত্ব পালনের জন্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা কমান্ডের দায়িত্ব পালনের জন্য উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়ায় তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দাবি-দাওয়া বুঝতে পারছেন না বলে মন্তব্য করেন টুলু মিয়া। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ক্ষমতা আবার মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে দিতে অবিলম্বে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
মুক্তিযোদ্ধাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে পাবনা জেলা ইউনিটের প্রতিনিধি আমিন উদ্দিন মোলা বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা জাতির হৃদয়ে আছে, কিন্তু সংবিধানে নেই। আজকে আমি দাবি করছি, আমাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হোক।
তিনি বলেন, অনেকে আছেন মুক্তিযুদ্ধ করেননি, এমন ব্যক্তিদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া পাঁয়তারা চলছে। আমাদের পক্ষ থেকে সোচ্চার ভূমিকা নিতে হবে যাতে করে কেউ এভাবে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হতে পারেন। ‘ভুয়া’ মুক্তিযোদ্ধাদের সনাক্ত করে তাদের বিচার করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনেরও দাবি জানান তিনি।
চুয়াডাঙ্গা জেলা ইউনিটের কমান্ডার আব্দুল মাবুদ জোয়ার্দার বলেন, রাজাকাররা প্রশাসন থেকে শুরু করে সব জায়গায় আজ প্রতিষ্ঠিত, এসব দেখলে আমাদের কষ্ট লাগে। তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করে এক শ্রেণির লোক নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাইছে, তা হতে দেওয়া হবে না। আব্দুল আহাদের নেতৃত্বে আমাদের একত্রিত থাকতে হবে।
ময়মনসিংহ জেলা ইউনিটের কমান্ডার আব্দুর বর বলেন, দীর্ঘদিন ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচিত কোনো কমিটি নেই, প্রশাসনের লোকেরা মুক্তিযোদ্ধাদের চালাচ্ছেন, প্রশাসনের লোকেরা জানে না আমাদের কী চাওয়া। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়ন করে না। মুক্তিযোদ্ধারা ভোট দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠন করে যোগ্য নেতৃত্ব চায়। অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হোক।
মুক্তিযোদ্ধারা যথাযথ চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে অভিযোগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতাল কারার দাবি জানান তিনি। ঢাকা মহানগর ইউনিটের কমান্ডার ফকির জিয়া উদ্দিন বলেন, অতীতে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচন হয়েছে, কিন্তু বার বার চক্রান্ত হয়েছে। আমার দাবি, অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দেওয়া হোক।
তিনি বলেন, এবারের নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করে আবারও অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরীকে সভাপতি নির্বাচিত করতে হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি ও এককালীন এক কোটি টাকা ভাতা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
দিনাজপুর জেলা ইউনিটের কমান্ডার আবু হায়াৎ মো. কুদরতে খুদা বলেন, আজ প্রায় দেড় বছর ধরে জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, থানা পর্যায়ে ইউএনও মুক্তিযোদ্ধাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমরা চাই অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচন দিয়ে যোগ্য নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাদের থেকেই করতে হবে।
ঢাকা জেলা ইউনিটের কমান্ডার এ কে এম করম আলী বলেন, সারা বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে নির্বাচন হয়েছে, হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছে দেড় বছর আগে, কিন্তু আমাদের নির্বাচন দেওয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রীর কাছে আহŸান জানাচ্ছি, আপনি দ্রুত এ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন।
তিনি বলেন, আজকে ভারতীয় তালিকা, লাল বার্তা তালিকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হচ্ছে। এটা ভালো। ১৯৯৮-৯৯ সালের একটি তালিকা আছে। পরে লাল বার্তা বের করা হয়েছে, সেখানে অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নেই। থানা কমান্ডারদেরও নাম নেই। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা যাতে বাদ না যায় সেভাবে তালিকা করার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আব্দুল আহাদ চৌধুরী বলেন, সমাবেশে অধিকাংশ বক্তার কথায় মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে প্রশ্ন এসেছে। ‘মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা বিদ্যমান, সেখানে বিভিন্ন নামে বিভিন্ন জনে যে সুবিধা নিচ্ছেন, তার পক্ষে আমি নই। মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা করা হবে তাতে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা কেউ যেন বাদ না পড়েন, তা আমি চাই।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের নির্বাচনের জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী নিরপেক্ষভাবে কাজ করছেন। আশা করছি একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সর্বশেষ নির্বাচন হয় ২০১৪ সালের ৪ জুন, তাতে কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হন হেলাল মোর্শেদ খান।
২০১৭ সালের জুনে ওই কমিটির মেয়াদ শেষে জেলা কমান্ডগুলোর দাবির প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে দেন। কিন্তু এরপর নির্বাচন না দিয়ে কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের দায়িত্ব পালনের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিবকে প্রশাসক, জেলা কমান্ডের দায়িত্ব পালনের জন্য জেলা প্রশাসক এবং উপজেলা কমান্ডের দায়িত্ব পালনের জন্য উপজেলার নির্বাহী অফিসারকে প্রশাসকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছিল অভিযোগ করে আহাদ চৌধুরী বলেন, এবার নির্বাচনে আপনারা ভোট দেবেন, ভোট গণনা করে কেন্দ্র থেকে বের হবেন। জেলা ও থানা পর্যায়ে এ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে মুক্তিযোদ্ধাদের আহŸান জানান তিনি।