লন্ডনে আশরাফের কষ্টের দিনের কথাও জানালেন ‘বোন’ হাসিনা
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
একাদশ সংসদের প্রথম অধিবেশনে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় সদ্যপ্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে নিয়ে বলতে গিয়ে ‘দুর্দিনের সহযোদ্ধার’ নানা স্মৃতি তুলে ধরলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পঁচাত্তরে পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়েছে তার মেয়ে হাসিনাকে। অনেকটা একই ঘটনা ঘটে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ছেলে আশরাফের জীবনেও।
ওই বছরেরই ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নজরুল ইসলামসহ জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর সৈয়দ আশরাফ চলে যান লন্ডনে। প্রায় দুই দশক পর দেশে ফিরে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন তিনি। এরপর থেকে টানা চার বার কিশোরগঞ্জ-১ আসনে সাংসদ নির্বাচিত হন তিনি।
গত ৩ জানুয়ারি মারা যাওয়া সৈয়দ আশরাফ সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত¡াবধায়ক সরকার আমলে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাল ধরেছিলেন দলের। পরে দুই দফায় দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে শেখ হাসিনার অবস্থান পোক্ত হওয়ার আগে নির্বাসিত জীবনের সেই সময়েও তার সঙ্গী ছিলেন সৈয়দ আশরাফ।
সেই স্মৃতি তুলে ধরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী বলেন, ১৯৮০ সালে আমি লন্ডনে গিয়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ গড়ে তোলার কাজ করি। তখন আশরাফও আমার সঙ্গে ছিল। আমাকে বড় বোনের মত জানত। পঁচাত্তরে আমরা স্বজন হারিয়েছি প্রত্যেকেরই খুব কষ্টের মধ্যে দিনযাপন করতে হয়েছে। সততার সাথে চললে পরে কষ্ট করতে হয়। সৈয়দ আশরাফের কষ্টের সেই দিনগুলোর চিত্র ফুটে ওঠে শেখ হাসিনার বর্ণনায়।
তিনি বলেন, অনেক স্মৃতি আমার মনে পড়ে। লন্ডনে এমন একটা অবস্থার মধ্যে থাকত কখনো এমনও অবস্থা গেছে হয়ত খাবারের পয়সাও ছিল না। লন্ডনে কাজ করত আর সেই সাথে রাজনীতিও করত।
আশরাফের অর্থকষ্টের কথা বোঝাতে একটি ঘটনা উলেখ করেন শেখ হাসিনা: আমি যখন লন্ডনে রেহানার বাসায়, একদিন ফোন দিলে বলে আপা অনেক দিন বাড়ির রান্না খাই না। আমি বললাম চলে আসো। এতই সোজা সরল ছিল যে বলল, আসব তো ট্রেনের ভাড়া তো নেই।
আমি বললাম তুমি যে কোনোভাবে আসো আমি ব্যবস্থা করব। বড় বোনের কাছে যেভাবে আবদার করে সেইভাবেই আবদার করত আমার কাছে। আমার এতো বেশি কাছে ছিল যে, আপন ভাইয়ের মতো দেখতাম। পঁচাত্তরের ঘটনার পর শেখ হাসিনা যাদের কাছে পেয়েছিলেন, তাদেরই একজন সৈয়দ আশরাফ।
তিনি বলেন, কামালের সাথে তার খুবই বন্ধুত্ব ছিল। তার সাথে রাজনীতি করত বলে আমার কাছে তার আলাদা কদর ছিল। যে কোনো সমস্যা হলেই আমার কাছে আসত। কথা বলত।
বিরোধী রাজনৈতিক শিবির থেকেও প্রশংসিত সৈয়দ আশরাফের মূল্যায়নে শেখ হাসিনা বলেন, আশরাফ অত্যন্ত সৎ, মেধাবী ছিল। রাজনৈতিক জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও মেধাবী ছিল। সব সময়ই পড়াশুনোর মধ্যে থাকত। বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, তার সব খবর সে রাখত। আমিই তাকে লন্ডন থেকে এখানে নিয়ে এসে নির্বাচন করাই। প্রতিটি ক্ষেত্রে খুবই সততার সাথে দায়িত্ব পালন করেছে।
ওয়ান-ইলেভেনের পর আশরাফের ভূমিকা স্মরণ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, জরুরি অবস্থার সময়ে দলের দুঃসময়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই সময় সে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে। আজকে যে গণতন্ত্র ফিরে পেয়েছি এজন্য তার অবদান রয়েছে। ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত সৈয়দ আশরাফের চিকিৎসায় যথাসাধ্য চেষ্টা করার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মন্ত্রী হিসেবে চিকিৎসার খরচ যা দরকার তা দিতে পেরেছি। তার স্ত্রী যখন অসুস্থ ছিল তখনও খোঁজখবর রেখেছি। সব থেকে দুঃখজনক যে, স্ত্রী শিলা মারা গেল। তার কিছু দিন পরে আশরাফও মারা গেল। একটি মেয়ে লন্ডনে আছে। সে সেখানে চাকুরি করে, তার প্রতি সমবেদনা জানাই। তার ভাইবোনদের প্রতিও সমবেদনা জানাই।
আশরাফের জন্য শোকার্ত শেখ হাসিনা বলেন, আমি ভাবতে পারিনি এত তাড়াতাড়ি আশরাফ আমাদের ছেড়ে চলে যাবে। আশরাফের মত একজন মেধাবী মানুষকে হারানো দলের জন্য ও দেশের জন্য সত্যি ক্ষতিকর। ক্যান্সার তাকে আমাদের থেকে কেড়ে নিয়ে গেল। সৈয়দ আশরাফের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ নাসিম, আমির হোসেন আমু, রওশন এরশাদ, তোফায়েল আহমেদ ও শেখ ফজলুল করিম সেলিম।
সংসদের রেওয়াজ অনুযায়ী, চলমান সংসদের কোনো সদস্যের মৃত্যুতে তার জীবন ও কাজের উপর আলোচনা করা হয়। পরে অধিবেশন মুলতবি হয়। তবে রাষ্ট্রপতির ভাষণের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য অধিবেশন কিছু সময়ের জন্য বিরতি রাখা হয়। পরে মৃতদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া এবং এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।