November 21, 2024
লেটেস্টশিক্ষা ও সাহিত্য

রিয়ানা

তাবতিলা মরিয়ম মেঘা
এক
শীতের সকাল। রিয়ানা ঘুমোচ্ছে। এই শীতের সকালে ছয়- সাতটার সময় কম্বল দিয়ে ঘুমোতে কি যে মজা লাগে! কিন্তু প্রত্যেক দিন সকাল বেলা দেরি করে ঘুম ভাঙ্গে। রিয়ানার ও তাই। সকাল 10 টায় ঘুম ভাঙলো। ” রিয়ানা উঠ! ক্লাস সিক্সে পড়া একটা মেয়েকে এগারোটা পর্যন্ত ঘুমাতে কখনো দেখেছো?”  মা বলল। মা রোজই রিয়ানা কে ওঠানোর জন্য এই মিথ্যা কথাটা বলে। 9 টা বাজলে বলে দশটা, দশটা বাজলে বলে এগারোটা। এমনও হয়েছে যে, মা তাকে বারোটা বাজে বলে ডেকে দিল, কিন্তু রিয়ানা যখন ঘড়ি দেখে তখন সকাল সাতটা বাজে। রিয়ানার তখন অনেক রাগ হয়। শীতের সময় সকাল সাতটায় ওঠার মানে আছে?
” রিয়ানা, টেবিলে ব্রেকফাস্ট আছে খেয়ে নাও। আর শোনো! তোমার পরীক্ষার  রেজাল্ট এসেছে। 100 তে 95 পেয়েছো। কিন্তু সামিহা পেয়েছে 96। কিভাবে ও তোমার থেকে বেশি পেল? আজকে  দুপুরে সমাজ বই নিয়ে আমার কাছে আসবে।”
” ঠিক আছে”
” আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে তুমি সামিহার থেকে কম নাম্বার পেয়েছো।”
রিয়ানা নাস্তা খেয়ে চলে গেল পার্কে হাঁটতে। সেখানে রুমকি ও ঝুমকি নামক দুজন জমজ বোন থাকে। তাদের সাথে রিয়ানার সম্পর্ক ঠিক ডোরেমন কার্টুনের জিয়ান, শুনিও এবং নবিতার মত। রুমকি ঝুমকি রিয়ানাকে খুব জ্বালাতন করে।
” ওইযে দেখো! রিয়ানা আসছে।” রুমকি ঝুমকিকে বলল।
” হাই, রিয়ানা।”
” হাই”
” শোনো, রাস্তায় ভালোভাবে দেখেশুনে হাঁটবে। কে জানে কখন ,,,,,,,”
রুমকির কথা না শেষ হতেই রিয়ানা পড়ে গেল। কারণ ঝুমকি নিচে একটি কলার খোসা ফেলেছে।
” পড়ে যাবে!” এই বলে রুমকি ঝুমকি হাসতে লাগলো।
” সরি, রিয়ানা। আমি ইচ্ছা করে ফেলি নাই।”
” আমি জানি তুমি ইচ্ছা করে ফেলেছ।”
রুমকি ঝুমকি হাসতে লাগল।
দুই
বিকেলে রিয়ানা বাড়ি ফিরল। পড়ে যাওয়ার কারণে তার মাথায় খুব ব্যথা লেগেছে। মনে হয় না কাল স্কুলে যেতে পারবে। সে মার কাছে সমাজ পড়ল। বাবার সাথে গল্প করল। একসাথে ভাত খেল। রাতে খেয়ে রিয়ানা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল। কিন্তু তার ঘুম আসছে না। রুমকি ও ঝুমকির কথা মনে হচ্ছে। কি পাজী ওরা! ছোটবেলা থেকেই রিয়ানাকে জ্বালিয়ে আসছে।  একদিন এমন ব্যথা দিয়েছিল ব্যথা দিয়েছিল যে, এখনো রিয়ানার পায়ের ব্যথার দাগটা আছে । অবশেষে রিয়ানার ঘুম এল। কিন্তু চারদিক হঠাৎ কেমন কালো হয়ে গেল। একটা পাঁচ-ছয় বছরের মেয়ে বসে আছে। কেঁদে কেঁদে মেয়েটি বলল,
” আমি পায়ে ব্যথা পেয়েছি”
” তুমি কে?”
” এটা কোথায় আমি” মেয়েটি বলল।
” চিন্তা করো না। বোঝাই যাচ্ছে যে এটা একটা স্বপ্ন।”
” না, এটা স্বপ্ন না।”
তখনই সবকিছু রঙিন হয়ে গেল। সবুজ গাছ ,নীল আকাশ। আশেপাশের সব বিল্ডিং কেমন পুরনো দেখা যাচ্ছে। রিয়ানা দেখল সে এখন পার্কে আছে। সবকিছু পুরানো। রিয়ানা দেখল মেয়েটির নেই। সে কিছুই বুঝতে পারলো না তার সাথে কি হচ্ছে। রিয়ানা বাড়িতে গেল।
” রিয়ানা! তুমি ফিরে এসেছো? আসো আমি তোমার হাত ধুয়ে দিই।” মা বলল।
” এসব কি বলছ মা? আমিতো আমার হাত নিজে ধুতে পারি।”
” কি? ও আচ্ছা। তুমি করো”
রিয়ানা খুব সুন্দর করে হাত ধুলো। এই দেখে তার মা অবাক হয়ে গেল।
” রিয়ানা! খুবই সুন্দর করে হাত ধুলে তুমি। আসো আমি তোমাকে খাইয়ে দিই । “
” মা, কিন্তু আমি তো নিজে খেতে পারি, তুমি এসব কি বলছ?”
” তুমি খেতে পারো? আচ্ছা দেখি খাও।”  মা ভয় হাসি দিয়ে বলল। ( মানুষ ভীত হয়ে যে হাসি দেয় তাকে বলে ভয় হাসি)
রিয়ানা খুব সুন্দর করে ভাত খেলো। এই দেখে তার মা তো প্রায় কেঁদে ফেলবে।
” তুমি একা খেতে পেরেছো! আমি এখনই সবাইকে জানিয়ে আসি!”
রিয়ানা কিছু বুঝলো না। এসব কি হচ্ছে? সব সময় তো রিয়ানা একাই খায়।
” হ্যালো শুনেছ !তোমার মেয়ে আজকে সবটুকু ভাত একা খেয়েছে । হ্যাঁ !আমিও বিশ্বাস করতে পারছি না।”
বিকেলে যখন রিয়ানা টিভি দেখছিল, তখন মা বলল,” আসো তোমাকে আমি অংক করাবো”
রিয়ানা মায়ের কাছে গেল।
” আচ্ছা বলতো , ২ + ৪ কত হয়?”
” হাহাহাহা মজা করো না! এত সহজ অংক দিয়েছো কেন? এর উত্তর হলো ৬।”
” ভেরি গুড আচ্ছা আরো কঠিন দিই । ১০+৪ কত হয় ? “
” 14, মা এগুলোতো পানির মতো সহজ। পেন দাও আমি তোমাকে একটা অংক করে দেখাই। এইযে:
{৬×(১৮÷২)+১২×(৬৪+৪২)}
এর উত্তর হলো: 1326।”
মা এখন কেঁদে দিল।
” রিয়ানা তুমি এত কঠিন অংক কিভাবে করলা? সারা পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে আসবো।”
রিয়ানা অবাক হয়ে গেল। রাতে ওর জন্য একটা পার্টি রাখা হলো। জিনিসটা আজব হলেও রিয়ানা খুব আনন্দ পাচ্ছিল। রিয়ানা একটা কান্ড ঘটালো সেটা খবর কাগজে ছাপানো হবে। কারণ তার বাবা প্রথম আলোর অনেক বড় সদস্য। সবার নিজের প্রশংসা শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু এত বেশিও না। রিয়ানা ক্লান্ত হয়ে গেল।  ক্লান্ত হয়ে পার্কের বেঞ্চে বসলো। কিন্তু একি হলো? রিয়ানা ওই ছোট মেয়েটিকে দেখতে পেল।
” আরে! তুমি এখানে? তুমি কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলে?”
মেয়েটি মুচকি হাসলো।
” তুমি কি জানো আমার সাথে এগুলো কেন হচ্ছে?”
মেয়েটি আবারও হাসলো।
” তোমার নাম কি?”
মেয়েটির চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো । বলল,
” তুমি কি আমার সাথে খেলবে? “
” আগে তোমার নামটি বলো।”
মেয়েটি হাসলো।
” তুমি কী খেলতে চাও?” রিয়ানা বলল।
” রান্না বাটি।”
” ও এই খেলাটা? … জানো আমি ছোটবেলায় খেলাটা আমার বাবার সাথে খুব খেলতাম।”
শুরু করল। গাছের পাতা দিয়ে সবজি বানানো। বোতলের পানি দিয়ে সুপ বানালো। টিসু ছিড়ে ভাত বানালো। আর গাছের ডাল দিয়ে বানালো সসেজ। প্রথমদিকে রিয়ানার এমন বাচ্চাদের খেলা খেলতে লজ্জা লাগতো।  এখন আর লাগে না। সে মনের আনন্দে ছোট মেয়েটির সাথে খেলে।
তিন
রাতের বেলা রিয়ানা তার বাবার কাছে গেল।
” বাবা আমাকে একটা জলরং কিনে দাও না।”
” না। তুমি এত ছোট বয়সে জল রং দিয়ে কি করবা?”
” ছোট বয়স! বাবা আমার বয়স 13।”
বাবা হাসতে লাগলো।
” মেয়েটা বলে কি? রিয়ানা মজা করো না।”
” আমি মজা করছি না”
বাবার হাসি থামল না।
”  ঠিক আছে। আমি যদি জল রং দিয়ে ছবি না আঁকতে পারি, তাহলে তুমি নিয়ে যাবে।”
” deal ” বাবা হেসে বলল।
” বাবা তুমি এখনো হাসছো কেন?”
” তুমি যে বললে তোমার বয়স 13, তাই।”
” আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না? ঠিক আছে। মা, আমার কত বছর ,বল তো?”
” 6 বছর ,আর কত?” মা বলল।
বাবা হাসতে লাগলো।
” মা তুমিও ভুলে গেলে? আমার বয়স 13।”
বাবা-মা দুজনেই হাসতে থাকলো।
” ঠিক আছে। নানু আমার বয়স সব সময় মনে রাখে। মা, ফোন দাও নানুকে ফোন করবো।”
রিয়ানা নানু কে ফোন দিল।
” হ্যালো”
” হ্যালো নানু?”
” আরে! রিয়ানা সোনা ! কি হয়েছে?”
” নানু ,বলতো আমার বয়স কত?”
” তোমার বয়স 6।”
 রিয়ানা চমকে গেল। নানু তো সব সময় তার বয়স মনে রাখে। কি হলো?”
” হ্যালো রিয়ানা ? লাইনে আছো?”
” হ্যাঁ নানু। আচ্ছা রাখি।”
রিয়ানা ফোন রেখে দিল।
” বলেছিলাম না?” বাবা বলল।
রিয়ানা মন খারাপ করে নিজের রুমে চলে গেল। তার খুব মন খারাপ হলো। এগুলো তার সাথে কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? যাই হোক না কেন, তার সাথে ওই ছোট মেয়েটার সাথে একটা সম্পর্ক আছে। কাল যে করেই হোক মেয়েটির সাথে কথা বলতে হবে।
পরদিন সকালে রিয়ানা পার্কে গেল। দেখলো
 ছোট মেয়েটি কাগজ দিয়ে নুডুলস বানিয়েছে। তার দিকে তাকিয়ে হাসছে।
হঠাৎ করে মেয়েটির হাত থেকে কাগজের নুডুলস এর বাটিটা পড়ে গেল। রিয়ানা যখন তুলতে যাবে তখন সে দেখল মেয়েটির পায়ে এখনো ব্যথার দাগ আছে।
” আরে দাগটা এখনো আছে ? তার মানে তুমি বোধহয় খুব ব্যথা পেয়েছিলে।”
রিয়ানা তার পায়ের কেটে যাওয়া দাগ দেখালো।
” দেখো আমার পায়ে দাগ আছে। রুমকি  ও ঝুমকি ব্যাথা দিয়েছিল।
ঠিক তখনই মেয়েটি উধাও হয়ে গেল। রিয়ানা কিছুই বুঝল না।
আজকের রিয়ানা তার বাবার আনা জলরং এর প্যাকেট খুললো। সে একটি ছবি আঁকতে শুরু করলো। একটা দৃশ্যের ছবি আঁকল। সে খুব সুন্দর ছবি আঁকতে পারে। কিন্তু আজকের টা একটু বেশি সুন্দর হয়েছে।  রিয়ানা ছবিটা নিয়ে তার মার কাছে গেল।
” মা দেখো আমি এই ছবিটি এঁকেছি।”
” ওয়াও! রিয়ানা কি সুন্দর! আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমি এখনই সবাইকে বলি। “
আরে মা! এরকম বলার কি দরকার? ছবি পাঠায় দাও না।”
” পাঠাবো কিভাবে?”
” ছবি তুলে ম্যাসেঞ্জারে পাঠায় দাও।”
” মেসেঞ্জার কি জিনিস?”
” এটা কি বলছ? মেসেঞ্জারে তুমি চেনো না?”
দাও আমি বের করে দিই।
রিয়ানা অনেক খুঁজলো। কিন্তু মোবাইলে মেসেঞ্জার পেল না। সে অবাক হলো।
” রিয়ানা এদিকে আসো ।তোমার দাদু তোমার সাথে কথা বলবে।”
” একি বলছে মা। দাদুর সাথে কথা বলবো? কিন্তু দাদু তো দুই বছর আগে মারা গেছে। ও বুঝছি। মা বোধহয় নানু ভুলতে গিয়ে দাদু বলে ফেলেছে । আমিও না কি সব ভাবি! ” রিয়ানা মনে মনে বলতে লাগল।
” হ্যালো,  নানু।”
” না  আমি নানু না। আমি দাদু।”
” কেমন আছো দাদু?”
” ভালো আছি।”
” আচ্ছা রাখি। আমি ঘুমোতে যাবো।”
 রিয়ানা ফোন রেখে দিল । সে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওকি ডোরেমনের কোন ক্যারেক্টার হয়ে গেল নাকি?  টাইম মেশিনে করে অতীতে এসেছে। রিয়ানা ঘুমিয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পরে আবার সবকিছু কালো হয়ে গেল। রিয়া দেখতে পেল অনেক দূরে তার দাদু বসে আছে। সবকিছু কাল। শুধু দাদুর পোশাকটা রঙিন।
” দাদু?”
 দাদু রিয়ানার দিকে ফিরল।
” তুমি মর নাই?তুমি বেঁচে আছো?” খুশি হয়ে জিজ্ঞাসা করল রিয়ানা।
” না রিয়ানা, আমি মরে গেছি।”
” তাহলে  আমার সাথে কি হচ্ছে?”
” তুমি অতীত দেখছো, রিয়ানা।”
” কিন্তু আমি তো এই অতীতে একদম 13 বছরের মতো আছি ।তাহলে সবাই আমাকে ছয় বছরের ছোট হিসেবে দেখে কেন?”
” তুমি 13 বছরেই আছো। কিন্তু সবার চোখে এমন দেখাচ্ছে যে, তুমি ছয় বছরের।”
” আর ওই ছোট মেয়েটা কে?”
” ওটা আসলে তুমি।  কেউই ওই মেয়েটা কে দেখতে পায় না। কিন্তু তুমি পাও। মেয়েটিকে তুমি কল্পনা করেছ। আর দেখো, তোমারও পায় একটা ব্যথার দাগ আছে, মেয়েটিরও আছে।”
” ও! তাহলে কি এই অতীত থেকে আমি কখনো বের হতে পারব না?”
” অবশ্যই পারবা। যদি তুমি চাও। “
” হ্যাঁ আমি চাই।”
”  তাহলে চোখ বন্ধ করে বল, আমি আমার আসল দুনিয়ায় যেতে চাই।”
রিয়ানা দাদুকে জড়িয়ে ধরল। ” থ্যাংক ইউ দাদু!”
” আমি আমার আসল দুনিয়ায় যেতে চাই।”
তখনই আবার সবকিছু কালো হয়ে গেল। একটু পরে রিয়ানা দেখলো সে একটা হসপিটালে শুয়ে আছে । তার পাশে তার বাবা-মা কাঁদছিল। রিয়ানা কে দেখে জড়িয়ে ধরল।
চার
২ বছর পর,,,,,,,,,,,,,,,
রিয়ানা আজ অনেক খুশি। আজ হসপিটাল থেকে তার ছোট বোনকে আনা হবে। রিয়ানার সাথে আছে মুনার মা। বাকি সবাই হসপিটালে। মুনার মা মনের দুঃখে তার পছন্দের সিরিয়াল “কিরণমালা” দেখছে।
” এহন কিরনমালার কি হইব? আল্লাহ গো! কিরনমালার কি হইব!” মুনার মা কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করলো।
তখনই বেল বাজলো। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো রিয়ানা। দরজা খোলার পর সে দেখল বাবার কোলে একটা ফুটফুটে বাচ্চা। রিয়ানা তার ছোট বোনকে পেয়ে খুব খুশি হলো।
” মুনার মা, তুমি কাঁদছিলে কেন? কিরণমালা দেখে?” মা বলল।
” কি কন আফা! আমি যদি কিরনমালা দেহে কাঁদি, তাইলে আমার উপর যেন ঠাডা পড়ে।”
 সবকিছু ঠিক ছিল। একটা জিনিস বাদে। ছোট বাচ্চাটার পায়েও একটা দাগ ছিল।  এটা কি করে সম্ভব?
শেয়ার করুন: