৩ বিচারকের সমন্বয়ে আইসিটি পুনর্গঠন, এ মাসেই বিচার কার্যক্রম শুরু
ছাত্র-জনতা হত্যার বিচারে তিন বিচারকের সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) পুনর্গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। ট্রাইব্যুনালের নতুন চেয়ারম্যান হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার। চলতি মাসে আদালত কার্যক্রম শুরু করবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
সোমবার (১৪ অক্টোবর) সন্ধ্যার পর সচিবালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে উপদেষ্টা এ কথা জানান।
তিনি বলেন, ‘আমরা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শক্রমে হাইকোর্টের দুজন বিচারপতি এবং একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজকে নিয়ে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের কাজ সম্পন্ন করেছি। এ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার। এছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন হাইকোর্টের আরেকজন বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘এর মাধ্যমে আমাদের আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করার ছিল এই বিচারকাজ শুরু করার ব্যাপারে, এটার একটা বড় ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা আশা করবো খুব শিগগির, অচিরেই বিচার কাজ শুরু হয়ে যাবে।’
‘এটা বিচারিক প্রক্রিয়া, কোনো কিছুই আমাদের হাতে নেই। বাস্তব অবস্থার ভিত্তিতে যদি বলেন বিচারপতিরা হয়তো এই মাসের মধ্যেই বসতে পারেন।’
উপদেষ্টা বলেন, ‘বিচারকাজের প্রাথমিক যে প্রি-ট্রায়াল স্টেজ যেখানে ইনভেস্টিগেশন করতে হয়, আলামত সংগ্রহ করতে হয়, সেটার কাজ আমাদের অত্যন্ত দক্ষ প্রসিকিউশন এবং ইনভেস্টিগেশন টিম শুরু করেছে। আমি যতটুকু অবগত হয়েছি ওনারা খুব ক্রেডিবল (নির্ভরযোগ্য) অনেক তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এখন বিচারিক কাজ অচিরেই শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানকালে যে নির্মম হত্যাকাণ্ড হয়েছে, এক হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যা করা হয়েছে। হাজার হাজার ছাত্র-জনতাকে আহত করা হয়েছে। এই অপরাধের বিচারের একটা শক্তিশালী ফোরাম বলবো এ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত। সেটা সম্পূর্ণভাবে কার্যকর হয়ে যাবে দু-একদিনের মধ্যে।’
আসিফ নজরুল বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে আর কিছু করার নেই। এরপর ধাপে ধাপে আমাদের কাছে যে সহযোগিতা চাওয়া হবে, যদি বলা হয় প্রসিকিউশন টিমে আরও লোক দরকার, অনুসন্ধান টিমে আরও লোক দরকার, যদি মনে করা হয় আদালতে আরেকটি ট্রাইব্যুনাল দরকার- এভাবে আমাদের কাছে সহযোগিতা চাওয়া হলে আমরা দিতে প্রস্তুত আছি।’
১৯৭৩ সালের আমাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইনের সমন্বয়টা কীভাবে করবেন- জানতে চাইলে আসিফ নজরুল বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে যে আইনটা ছিল, সেটা আমরা অনেকটা উন্নয়নের চেষ্টা করছি। এটা নিয়ে আমরা অংশীজনদের সঙ্গে মিটিং করেছি। আমরা এটার কিছু কিছু উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনছি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের যে কেউ এখানে পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকতে পারবেন। আসামিপক্ষে যারা আছেন, তারা যে কোনো দেশের আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবেন। এ মাসের মধ্যে আইনের সংশোধন চূড়ান্ত হয়ে যাবে। আইন সংশোধনের জন্য কিন্তু বিচার আটকে থাকবে না।’
বিচারে যারা অপরাধী হিসেবে বিবেচিত হবেন, তাদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা হবে কীভাবে- এ বিষয়ে তিনি বলেন, পলাতকদের বিচার করার বিধান এই আইনে রয়েছে। উনারা যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তবে যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী তাদের বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করবো। তাদের সঙ্গে চুক্তি নেই তাদের ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী যতটুক চেষ্টা করা যায় আমরা আনবো।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দোষী সাব্যস্ত হলে, তখন তিনি যদি ভারতে থাকেন তাকে বন্দি প্রত্যার্পণ চুক্তি অনুযায়ী অবশ্যই চাওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন উপদেষ্টা।
গুম নিয়ে কোনো আলাদা আইন নেই জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে আমরা গুমের অপরাধ সংযোজন করছি। আমরা তো গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে পক্ষ দেশ।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধী হিসেবে গুমের বিচার করারও সুযোগ থাকবে। গুমের অপরাধের বিষয়ে নতুন আইন করার উদ্যোগ নেওয়া হবে বল জানিয়েছেন আসিফ নজরুল।
বিচারের ক্ষেত্রে কোন সময়ের হত্যাকাণ্ড বিবেচনায় নেওয়া হবে জানতে চাইলে আইন উপদেষ্টা বলেন, এটা মূলত প্রসিকিউশন টিমের বিষয়। আমি যতটুক শুনেছি ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিচার করা হবে। তবে পরবর্তীতে দু-একদিন এদিক-সেদিক হতে পারে। এছাড়া এরমধ্যে শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড, বিডিআর হত্যাকাণ্ডও আসতে পারে।
সরকারি আইনজীবী নিয়োগ
আইন উপদেষ্টা বলেন, পিপি, জিপি ও অ্যাডিশনাল পিপির অভাবে আমাদের নিম্ন আদালতে বিচারকাজ ব্যাহত হচ্ছিল। গত ফ্যাসিস্ট সরকারের সময় প্রায় সাড়ে চার হাজার সরকারি উকিল ছিল, গত ৫ আগস্টের পর দু-একজন ছাড়া সবাই পালিয়ে গেছেন বা আত্মগোপনে আছেন। তাই আমাদের জিপি, পিপি, অতিরিক্ত পিপি নিয়োগ দিতে হয়েছে। বাইরে থেকে বোঝা যায় না যে, নিয়োগ দিতে এত সময় লাগছে কেন।
সাড়ে চার হাজার সরকারি আইনজীবী নিয়োগ দেওয়ার জন্য প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার আবেদন এসেছে জানিয়ে তিনি বলেন, এটি যাচাই-বাছাই করে একটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষে সাড়ে চার হাজার বাছাই করা, আমার মন্ত্রণালয়ের কী যে পরিশ্রম গেছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের! সেটা বোঝাতে পারবো না।
‘আজ আমি ঢাকা জেলার সাতশোর মতো সরকারি আইনজীবী নিয়োগে ফাইলে স্বাক্ষর করেছি। এখানেও আবেদনপত্র ছিল প্রায় ১০ হাজারের মতো।’
তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলের প্রচুর মিথ্যা এবং হয়রানিমূলক মামলা হয়েছে সেই মামলাগুলো আমরা প্রত্যাহার করতে পারছিলাম না। অনেকে বলছে আমরা কেন মিথ্যা হয়রানিমূলক এত মামলা প্রত্যাহার করছি না। আমরা তো চাইলেই প্রত্যাহার করতে পারবো না। যে মামলায় চার্জশিট হয়নি, তদন্তের পর্যায়ে আছে, সেটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মিলে প্রত্যাহারের সুযোগ থাকে। চার্জশিট হয়ে যাওয়া মামলা প্রত্যাহারের জন্য পিপিকে আবেদন করতে হয়। অথবা বিচারকার্য সম্পন্ন করে যিনি আসামি আছেন তাকে মুক্তির সুযোগ খুঁজতে হয়।
উপদেষ্টা বলেন, যে মামলায় সাজা হয়ে গেছে, সেই মামলা আমরা কেন প্রত্যাহার করছি না- সেই প্রশ্নও তোলা হয়। আইনটা তো একটু জানা থাকলে ভালো হয়। যে মামলায় সাজা হয়ে গেছে, সেই মামলা যতই মিথ্যা হোক ষড়যন্ত্রমূলক অবিশ্বাস্য মামলা হোক- যার বিরুদ্ধে শাস্তি হয়েছে তার আবেদন ছাড়া স্বতঃপ্রণোদিতভাবে আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো কিছু করার নাই।
‘আমাদের যা করার আমরা করছি, যথেষ্ট চেষ্টা করছি। ভুল থাকবে, তবে একটা জিনিস নিশ্চিত থাকেন- বেআইনিভাবে কোনো কিছু করার সুযোগ বা ইচ্ছা আমাদের নেই’ বলেন আসিফ নজরুল।