March 13, 2025
আন্তর্জাতিকলেটেস্ট

হাসিনার শাসন দুর্নীতি, সহিংসতা ও স্বৈরাচারের অভিযোগে কলঙ্কিত ছিল: দ্য গার্ডিয়ান

মুহাম্মদ ইউনুস যখন গত আগস্টে বাংলাদেশে ফিরে আসেন, তখন তিনি একটি হতাশাজনক দৃশ্যের মুখোমুখি হন। রাস্তাগুলো তখনো রক্তে ভেজা ছিল, এবং পুলিশের গুলিতে নিহত ১,০০০ জনেরও বেশি বিক্ষোভকারী ও শিশুর মরদেহ মর্গে স্তূপ করে রাখা হয়েছিল।

সোমবার (১০ মার্চ) প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎকারভিত্তিক প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এসব তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।

শেখ হাসিনা ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পর ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিপ্লবে ক্ষমতাচ্যুত হন। প্রতিশোধপ্রবণ সাধারণ মানুষ তার বাসভবন তছনছ করার সময় তিনি একটি হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান।

৮৪ বছর বয়সী ইউনুস, যিনি দরিদ্রদের জন্য মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যবস্থা প্রবর্তনের মাধ্যমে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছিলেন, বহু আগেই রাজনীতি থেকে সরে গিয়েছিলেন। হাসিনা তাকে রাজনৈতিক হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতেন এবং বছরের পর বছর তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও হয়রানি চালানো হয়েছিল। ফলে তিনি দীর্ঘ সময় বিদেশে কাটান।

কিন্তু যখন বিক্ষোভকারী ছাত্ররা তাকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিচালনার জন্য আহ্বান জানায়, তখন তিনি গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যখন ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখনকার অবস্থা বর্ণনা করে দ্য গার্ডিয়ানকে তিনি বলেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) যে ক্ষতি করেছেন তা ছিল বিপর্যয়কর। বাংলাদেশ পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত এক দেশ, যেন আরেকটি গাজা। তবে পার্থক্য হলো এখানে দালান নয়, ধ্বংস হয়েছে প্রতিষ্ঠান, নীতিমালা, মানুষ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক।’

হাসিনার শাসন দুর্নীতি, সহিংসতা ও স্বৈরাচারের অভিযোগে কলঙ্কিত ছিল। এর চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় গত জুলাই ও আগস্টে, যখন তার দমনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে পুলিশের সহিংস হামলায় এক হাজার ৪০০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়। জাতিসংঘ এই সহিংসতাকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে অভিহিত করেছে, যদিও হাসিনা অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ইউনুসের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনকে নতুন যুগের সূচনা হিসেবে দেখা হয়। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর ছয় মাসের মধ্যে উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের হাসিনার শাসনে বিচারবহির্ভূত হত্যার জন্য বিচারের আওতায় আনা হয়েছে, গোপন কারাগারগুলো খালি করা হয়েছে —যেখানে হাসিনার সমালোচকদের নির্যাতন করা হতো এবং মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। হাসিনার বিরুদ্ধে শত শত মামলা দায়ের করা হয়েছে, যদিও তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

ইউনুস প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৬ সালের মার্চের মধ্যে বাংলাদেশের প্রথম অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, যার পর তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।

ঢাকার রাস্তায় হাঁটলে এখন এক অস্থির পরিস্থিতি চোখে পড়ে। ইউনুস এখনও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব হলেও তার শাসন দক্ষতা ও প্রতিশ্রুত সংস্কারের গতি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। রাজনৈতিক দল, বিশেষত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) দ্রুত নির্বাচনের জন্য চাপ দিচ্ছে। ছাত্র আন্দোলনকারীরাও নিজেদের রাজনৈতিক দল গঠন করেছে।

বিএনপির সিনিয়র নেতা আমির চৌধুরী বলেন, ‘এই সরকার শুধু অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে গঠিত হয়েছিল। এখন কারো প্রতি নিয়মিত জবাবদিহিতা নেই। আর সংস্কারের জন্য তাদের প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক শক্তি ও ম্যান্ডেট নেই।’

আইনশৃঙ্খলার অবনতি

পুলিশ সদস্যরা, যারা হাসিনার শাসনের সময় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য বিচারের মুখোমুখি, তারা কাজে ফিরতে অনিচ্ছুক। ফলে দেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। ঢাকার রাস্তায় গ্যাং অপরাধ বেড়ে গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হয়রানির ঘটনা বাড়ছে।

সোমবার বিক্ষোভকারীরা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। কারণ, তিনি ক্রমবর্ধমান অপরাধ দমনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।

ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টির (এনসিপি) প্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা অসম্ভব।’

শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত সপ্তাহে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘দেশ বর্তমানে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে রয়েছে এবং যদি বিভাজন অব্যাহত থাকে, তবে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়বে।’

ইউনুস অবশ্য দাবি করেছেন সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার ‘খুব ভালো সম্পর্ক’ রয়েছে এবং কোনো চাপ নেই। তবে অনেকেই তার মন্তব্যকে ইউনুসের নেতৃত্বের প্রতি কঠোর সমালোচনা এবং সামরিক হস্তক্ষেপের ইঙ্গিত হিসেবে দেখছেন।

ড. ইউনূস দেশের সংকটগুলোকে শেখ হাসিনার শাসনের পরিণতি হিসেবে উপস্থাপন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি বলেন, ‘হাসিনার শাসনামল কোনো সরকার নয়, এটি ছিল একটি দস্যু পরিবার। বসের (হাসিনা) যেকোনো আদেশ কার্যকর করা হয়েছে। কেউ সমস্যা তৈরি করছে? আমরা তাদের অদৃশ্য করে দেব। নির্বাচন করতে চান? আমরা নিশ্চিত করব যে আপনি সমস্ত আসনে জয়ী হন। আপনি টাকা চান? এখানে ব্যাংক থেকে এক মিলিয়ন ডলার ঋণ নিন যা আপনাকে কখনও ফেরত দিতে হবে না।’

হাসিনার শাসনামলে দুর্নীতি দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। হাসিনার পরিবারের সদস্যরাও অর্থ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার বোন শেখ রেহানার মেয়ে ও যুক্তরাজ্যের লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিক বাংলাদেশে এক দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত হওয়ার পর ব্রিটেনের ট্রেজারি থেকে পদত্যাগ করেছেন। তবে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ডের আর্থিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের ব্যাংক থেকে লুট হওয়া আনুমানিক ১৭ বিলিয়ন ডলার উদ্ধার করার চেষ্টা করছে, কিন্তু এই অর্থ ফেরত পাওয়ার আশা ক্ষীণ।

ইউনুস বলেন, ‘সরকারের সক্রিয় অংশগ্রহণে জনগণের টাকা লুট করার পূর্ণ অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা তাদের কর্মকর্তাদের বন্দুক দিয়ে পাঠাত সবকিছু স্বাক্ষর করানোর জন্য।’

আন্তর্জাতিক চাপও ইউনুসের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। ভারত হাসিনাকে আশ্রয় দিয়েছে এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ক্রমশ অবনতির দিকে যাচ্ছে। দিল্লি সম্প্রতি বাংলাদেশকে ‘সন্ত্রাসবাদকে স্বাভাবিক করার’ অভিযোগে অভিযুক্ত করেছে।

২০২৫ সালের ডিসেম্বরে ভারতকে হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য অনুরোধ করা হলেও এখনও কোনো জবাব মেলেনি। হাসিনা তাকে ‘একজন সন্ত্রাসী’ বলে অভিহিত করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ইউনুসের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের সমর্থন থাকলেও, ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তন ইউনুসের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে অর্থায়ন কমিয়ে দিয়েছে এবং ইউএসএইডের বরাদ্দ বন্ধ করেছে।

ইউনুস ট্রাম্পের সহযোগিতা পেতে ইলন মাস্ককে বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেট নিয়ে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এপ্রিল মাসে মাস্কের বাংলাদেশ সফরের সম্ভাবনা রয়েছে।

ইউনুস বলেন, ‘ট্রাম্প একজন ডিলমেকার। তাই আমি তাকে বলব— আসুন, আমাদের সঙ্গে চুক্তি করুন। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থামবে না।’

শেয়ার করুন: