সহজ সরল মানুষকে টার্গেট করে দশ বছরে ৫০ জনের কিডনি বিক্রি
আব্বাস মিয়া (৪৫) নিজের কিডনি বিক্রি করেছেন। গড়েছেন কিডনি বিক্রি চক্রও। তার চক্রের মাধ্যমে অনেক মানুষ কিডনি বিক্রি করেছেন। তবু আব্বাসের অভাব ফুরায়নি। এখন স্ত্রীর একটি কিডনি বিক্রির প্রক্রিয়া করছেন তিনি। আব্বাস গুরুদাসপুর পৌর শহরের আনন্দ নগর মহল্লার বাসিন্দা।
আব্বাসের কিডনি বিক্রির শুরুটা হয়েছিল ঋণ পরিশোধের তাগিদে। এখন তা বাণিজ্যিক চক্রে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি এতো খারাপ হয়েছে যে, মানুষ আব্বাসের খপ্পরে পড়ে কিডনি বিক্রি করছেন দালাল খুঁজে খুঁজে। বিগত দশ বছরে প্রায় ৫০ ব্যক্তি তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন।
অনুসন্ধানে গুরুদাসপুরের কিডনি বিক্রির ভয়াবহতা চিত্র উঠে এসেছে। সূত্র মতে, ২০২২ সালের জুন মাস থেকে চলতি বছরের ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৮ ব্যক্তি তাদের একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন। এর মধ্যে দুই জন স্থানীয় ক্রেতা দুইটি কিডনি কিনেছেন। বাকি ছয়টি কিডনি বিক্রি হয়েছে অন্য এলাকায়। কিডনি বিক্রিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা চক্রের মাধ্যমেই এসব কিডনি বিকিকিনি হয়েছে। ধীরে ধীরে কিডনি বিক্রির সঙ্গে গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো জড়িয়ে পড়লেও এটি রোধে দৃশ্যত কোনো পদক্ষেপ নেই প্রশাসনের।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) রিপন দাস কুমার সাহা জানালেন, গত ছয় মাসে কিডনি সম্পর্কিত বেশ কয়েকটি তদন্ত করেছেন তিনি। অসুস্থ স্বজনদের কিডনি দানের আগ্রহ দেখিয়ে দাতারা কাগজে কলমে যে ঠিকানা ব্যবহার করেছেন বাস্তবে তার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তার ভাষ্যমতে, সর্বশেষ মাসখানেক আগে আত্মীয়কে কিডনি দানে আগ্রহী ছাবলু রহমান নামের এক ব্যক্তির তদন্ত করা হয়। কাগজপত্রে ওই ব্যক্তির নাম ঠিকানা পৌর শহরের খামারনাচকৈড় মহল্লা উল্লেখ করা হয়েছে। বাস্তবে ওই মহল্লায় একাধিক ছাবলুর সন্ধান পাওয়া গেলেও পিতার নামের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ কারণেই বেআইনিভাবে অঙ্গ বিক্রির এই চক্র শনাক্ত করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাদের।
স্থানীয়রা বলছেন, আব্বাস মিয়া প্রথমে নিজের কিডনি বিক্রি করে গুরুদাসপুরে শুরু করেন বেআইনি অঙ্গ বিক্রির অধ্যায়। নিজে কিডনি বিক্রির পর এলাকায় ফিরে অভাবি মানুষদের কিডনি বিক্রিতে উৎসাহিত করার কাজ করেন। তার কথায় অনেকেই কিডনি বিক্রি করেন। এভাবেই গড়ে ওঠে কিডনি বিক্রি চক্র। তার এই চক্রের মাধ্যমেই পৌর শহরের গাড়িষাপাড়া মহল্লার প্রায় ২০ ব্যক্তি একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন।
আব্বাস মিয়া যেভাবে কিডনি বিক্রিতে জড়িয়ে পড়ছেন তা নিজেই শোনালেন। তিনি জানান, প্রায় ১৮ বছর আগে অভাবের তাড়নায় পরিবারিক কলহ তৈরি হয়। অভাব মোচনের জন্য অর্থের জোগান দেওয়ার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। পরে ঢাকার এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়ের মাধ্যমে কিডনি বিক্রির সিদ্ধান্ত হয়। সে সময় তিনি নিজের একটি কিডনি বিক্রি করে দেন। সংসারে অভাব থাকায় এখন স্ত্রীর কিডনি বিক্রির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
কিডনি দাতা ও মধ্যস্থতাকারীরা জানিয়েছেন, সুস্থ একটি কিডনি বিক্রি করলে পাওয়া যায় চার থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা। আবার কেউ কিডনি দাতার যোগাড় করতে পারলে একটি করে কিডনি বাবদ দেওয়া হয় ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। তাই যারা কিডনি বিক্রি করেন তারাই আবার টাকার লোভে কিডনি বিক্রিতে অন্যদের উৎসাহিত করেন। এভাবেই চলছে গুরুদাসপুরের কিডনি ব্যবসা।
যে প্রক্রিয়ায় কিডনি নেওয়া হয়
দাম দরে মিলে গেলে দালালদের সঙ্গে খুব গোপনে ঢাকায় নেওয়া হয় দাতাকে। ঢাকায় বসে তৈরি করা হয় কিডনি দাতার যাবতীয় পরীক্ষার কাগজ। দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন সম্ভব না হয়ায় ভারতে নেওয়া হয়। সেখানেই তথ্য গোপন করে চলে কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ।
অনুসন্ধান মতে, গুরুদাসপুর উপজেলার নাজিরপুর, শিকারপুর, আনন্দনগর, গাড়িষাপাড়া, জুমাইনগর, বামনকোলা এবং পৌর শহরের চাঁচকৈড় বাজারপাড়া ও চাঁচকৈড় খলিফাপাড়ার অনেক মানুষ একটি করে কিডনি বিক্রি করেছেন।
এ সব এলাকার কিডনি দাতা, গ্রহীতা এবং বিক্রি চক্রের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা সবাই আব্বাসের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন এবং কিনেছেন। আব্বাস ছাড়াও কিডনি দাতাদের মধ্য থেকে অনেকেই কিডনি বিক্রির চক্র তৈরির চেষ্টায় রয়েছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কিডনি বিক্রেতা ইত্তেফাককে জানান, রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও টাকার জন্য বেড়গঙ্গারামপুরের এক ব্যক্তিকে কিডনি দিয়েছেন তিনি। কিডনি বিক্রি করে এখন তিনি রিক্সা মেকানিক্সের কাজ করেন। কারণ কিডনি দেওয়ার পর থেকে তার পক্ষে ভারী কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে কিডনি গৃহীতা জানালেন, সব প্রক্রিয়া শেষ করে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে চার প্রায় ৪৪ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।
কিডনি বিক্রেতা আরেক ব্যক্তি বলেন, অভাবের তাড়নায় আব্বাসের মাধ্যমে তিনি একটি কিডনি বিক্রি করেছেন। নিজে কিডনি দেওয়ার পর পাশ্ববর্তী আরও দুই ব্যক্তির কিডনি বিক্রিতে তিনি মধ্যস্থতা করেছেন। সংসারে অভাব থাকায় এখন স্ত্রীর কিডনি বিক্রি করবেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, কিডনি বিক্রি করলে মানুষ মরে না বরং ভালোই থাকে। তার মতো শুধু গাড়িষাপাড়া এলাকায় আব্বাসের মাধ্যমে কিডনি বিক্রি করেছেন ২০ ব্যক্তি।
গাড়িষাপাড়া মহল্লার এক কিডনি বিক্রেতা জানান, তিনি দুই লাখ টাকা ঋণ শোধ করতে চার লাখ টাকায় নিজের একটি কিডনি বিক্রি করেছেন। বিক্রির পর অন্য কাজ করতে পারলেও ভারী কাজ করতে সমস্যা হয়। পেটের বাম পাশের কাটা দাগ দেখিয়ে এই ব্যক্তি বলেন, ঠিক মতো মলম ব্যবহার করলে এসব দাগ মুছে যায়। তখন আর বোঝা যায় না। এখন আবার ঋণগ্রস্ত হওয়ায় তিনিও স্ত্রীর একটি কিডনি বিক্রির চেষ্টা করছেন। এ কারণে তিনি সব কাগজপত্রও দিয়েছেন দালাল চক্রের কাছে।
সম্প্রতি কিডনি প্রতিস্থাপন করা এক ব্যক্তি জানান, তার একটি কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। কিন্তু চিকিৎসা ব্যয় আর ডায়ালাইসিসের খরচ ব্যয়বহুল হওয়ায় তিনি কিডনি প্রতিস্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। দালালের মাধ্যমে কিডনি প্রতিস্থাপন করতে তার ব্যয় হয়েছে ৪৪ লাখ টাকা।
আইন যা বলছে
১৯৯৯ সালে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে যে আইন করা হয়েছিল, তাতে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয় ছাড়া শরীরের কোনো অঙ্গ দান করা যাবে না। এই আইন অনুযায়ী বেআইনিভাবে অঙ্গ বিক্রি করলে তিন থেকে সাত বছর পর্যন্ত সশ্রম করাদণ্ড এবং একই সঙ্গে ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেজ অ্যান্ড ইউরোলজির পরিচালক অধ্যাপক বাবরুল আলম জানান, দেশে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে দেশে নিকট আত্মীয় ছাড়া কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় না। কিডনি নেওয়ার আগে পুলিশি প্রতিবেদন চাওয়া হয়। পুলিশি প্রতিবেদন ঠিকঠাক হলে তবেই দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়।
গুরুদাসপুর থানার ওসি মো. মোনোয়ারুজ্জামান বলেন, খুব গোপনে দেশের বাইরে নিয়ে কিডনি ট্রান্সপারেন্ট করা হয়। তাছাড়া কোনো অভিযোগও পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে এই চক্রের লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন হচ্ছে।
নাটোর প্রতিনিধি