January 16, 2025
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

সংবিধান সংস্কার: রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ও দেশের সাংবিধানিক নাম বদলের সুপারিশ

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের অর্জন হিসেবে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়তে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিস্বরূপ সংবিধান সংস্কারে গঠিত কমিশন যে প্রতিবেদন দিয়েছে সেখানে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি, দেশের সাংবিধানিক নাম এবং সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তনের মতো সুপারিশ রয়েছে।

বুধবার (১৫ জানুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে প্রতিবেদন জমা দেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ। পরে তিনি সাংবাদিকদের কাছে তাদের সুপারিশগুলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।

আলী রীয়াজ বলেন, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের যে জনআকাঙ্ক্ষা; তার প্রতিফলন হিসেবে আমরা রাষ্ট্রের পাঁচটি মূলনীতি সুপারিশ করছি। সেগুলো হচ্ছে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র।

বর্তমান বাংলাদেশ সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ রয়েছে।

সেই মূলনীতির আলোকে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা করা হবে- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত’ করাকে রাষ্ট্রের লক্ষ্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে সংবিধানে।

বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ সুপারিশ প্রতিবেদন করার কথা প্রকাশ করেন সংস্কার কমিশনের প্রধান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে যেভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বলা হয়, তার মধ্যে আসলে যে প্রজাতন্ত্রের কথা হয়, সেটায় আমরা দ্বিমত পোষণ করেছি। আমরা বলেছি, বাংলাদেশের পরিচিতি হওয়া উচিত ‘জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ হিসেবে।

মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণের বিষয়ে সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের শিক্ষক আলী রীয়াজ বলেন, শুধু তাই নয়, আমরা সাংবিধানিকভাবে তার সুরক্ষা এবং তা যেন বলবৎযোগ্য হয়, তা নিশ্চিত করার জন্য একটা সমন্বিত একক সনদের কথা বলেছি।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রস্তুত করতে গিয়ে প্রায় এক লাখ মানুষের মতামত নেওয়ার কথা জানান আলী রীয়াজ। কমিশনের সদস্যদের পাশাপাশি ৩২ জন গবেষক এতে কাজ করেছেন।

অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, এই প্রতিবেদনের পেছনে আছে প্রায় এক লাখ লোকের মতামত; রাজনৈতিক দলগুলোর অবদান, আছে নাগরিক সমাজের অবদান এবং আছে সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষের মত।

তিনি আরও বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল সুস্পষ্ট- কার্যকর গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার সুনিশ্চিতকরণ এবং জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা। সেদিক থেকে বিবেচনা করে আমরা সংবিধানের যে ধারাগুলোর, যে বিষয়গুলোর সংস্কার করা দরকার সেগুলো আমরা বলেছি।

সুপারিশগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যের আশা করে তিনি বলেন, একটা ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্ন, সেই স্বপ্নের ধারাবাহিকতায় আজকে আসলে কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা এই প্রস্তাবগুলো, সুপারিশগুলো রাখছি। আমরা আশা করছি, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবে।

দ্বিকক্ষের সংসদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল

সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের পুনরুদ্ধার বা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা সুপারিশে তুলে ধরার কথা জানান সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রীয়াজ।

দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালুর প্রস্তাব করার কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, এ দুই কক্ষ মিলে যাতে সকলের প্রতিনিধিত্ব থাকে, তার জন্য একইসঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে নিম্নকক্ষ, কিন্তু সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বে উচ্চকক্ষ তৈরি করার জন্য সুপারিশ করেছি।

তিনি আরও বলেন, গত ১৬ বছর বাংলাদেশ যে ‘একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র মোকাবেলা করেছে’, তার একটা বড় কারণ ছিল ক্ষমতার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য ছিল না। সেই কারণে যাতে কোনো এক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে রাষ্ট্রক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে না পারে, সেজন্য রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গ এবং নির্বাহী বিভাগের দু’টি পদ, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা একটা চেক অ্যান্ড ব্যালেন্সের বিষয় হিসেবে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল নামে একটি সাংবিধানিক সংস্থা প্রবর্তনের সুপারিশ করেছি।

রাষ্ট্রপতি, প্রধান বিচারপতি, প্রধানমন্ত্রী ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা এবং সংসদের দু’কক্ষের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারদের পাশাপাশি অন্যান্য দলের প্রতিনিধিত্বকারী একজনকে এই কাউন্সিলে রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

এই প্রতিষ্ঠান সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক করতে পারবে বলে মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, এটা খুব সুস্পষ্ট যে, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস করার জন্য এবং যাতে করে তিনি একক ইচ্ছায় নির্বাচন কমিশনসহ অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগ করতে না পারেন; সেজন্য আমরা এগুলো জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে অর্পণ করার সুপারিশ করেছি।

প্রধানমন্ত্রীর বিষয়ে সংসদে অনাস্থা ভোটের সুযোগ ফেরানোর অংশ হিসেবে ৭০ অনুচ্ছেদ কেন্দ্রীক কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করার কথাও বলেন তিনি।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, আমরা মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়া দরকার, সে ব্যবস্থা করা দরকার। সে কারণে ৭০ অনুচ্ছেদ দ্বারা যাতে প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র সুরক্ষিত না হন, সেজন্য আমরা তার কিছু সংস্কারের প্রস্তাব করেছি।

নির্বাচকমণ্ডলীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সুপারিশ করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের যে পদ্ধতি তৈরি করা হয়েছে, তাতে ব্যক্তির ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় বলে আমরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। এক ধরনের নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্য দিয়ে যেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আমরা সেই সুপারিশ করেছি।

প্রধান উপদেষ্টা বাছাইয়ে সাংবিধানিক কাউন্সিল

নির্বাচনকালীন অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠনের বিষয়ে ‘সুস্পষ্ট কাঠামোর’ পরামর্শ প্রতিবেদনে দেওয়ার কথা তুলে ধরে আলী রীয়াজ বলেন, আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা পদে বাছাইয়ের দায়িত্বভার কোনো ব্যক্তি বা একক প্রতিষ্ঠানের ওপর থাকা ঠিক নয়। সে কারণে আমরা জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাছে এই বাছাই প্রক্রিয়া অর্পণ করেছি বা সুপারিশ করেছি। আমরা আশা করছি, সেটা সম্ভব হবে।

বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণের বিষয়ে বিভাগীয় শহরে হাই কোর্টের এখতিয়ার ও মর্যাদাসম্পন্ন আদালত স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়ার কথা বলেন তিনি।

সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারকে সুগম এবং যথাসাধ্য মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে হলে; কমিশন মনে করে, বিকেন্দ্রীকরণ করা দরকার। আমরা সুপ্রিম কোর্টের একক চরিত্র অক্ষুণ্ণ রেখেই দেশের সকল বিভাগীয় শহরে হাই কোর্ট বিভাগের এখতিয়ার এবং মর্যাদাসম্পন্ন একটি স্থায়ী আসনের সুপারিশ করেছি।

‘শক্তিশালী’ স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে ‘সমন্বয় কাউন্সিল’ গঠনের সুপারিশ করার কথা জানান তিনি।

আলী রীয়াজ বলেন, শুধু কমিশনের সদস্যরাই নন, অংশীজন যাদের সাথে কথা বলেছি, তাদের সকলেই প্রায় জোর দিয়ে বলেছেন, শক্তিশালীভাবে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সেজন্য আমরা স্থানীয় সরকার কমিশন গঠনের সুপারিশ করেছি। আমরা জেলা ও সিটি করপোরেশন পর্যায়ে সমন্বয় কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছি।

শেয়ার করুন: