শ্বশুর হত্যার লোমহর্ষক বর্ণনা দিলেন পুত্রবধূ
চট্টগ্রামে স্ত্রী-সন্তান ও পুত্রবধূ র হাতে নৃশংসভাবে খুন হন মো. হাসান (৬১)। শুধু তাই নয়, খন্ড-বিখন্ড করে তার লাশ ট্রলিব্যাগে ভরে ফেলে দেওয়া হয় চট্টগ্রাম মহানগরীর পতেঙ্গা এলাকায় সমূদ্র সৈকত এলাকায়। ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পতেঙ্গা সমূদ্র সৈকতের ১২ নম্বর গেইট থেকে লাশের খন্ডাংশ ভরা ট্রলিব্যাগ উদ্ধার করে পুলিশ।
কফি রঙের ট্রলিব্যাগে দুই হাত, দুই পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ পাওয়া গেলেও মাথা পাওয়া যায়নি। ফলে লাশের পরিচয়ও তাৎক্ষনিকভাবে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। তবে এ ঘটনা তদন্তে নেমে পুলিশ ব্যুরো ইনভেষ্টিগেশন (পিবিআই) লাশটি চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার কাথারিয়া ইউনিয়নের বড়ইতলী গ্রামের সাহাব মিয়ার ছেলে মো. হাসানের বলে শনাক্ত করেন। উদঘাটন করেন পুরো হত্যাকান্ডের রহস্য।
এরপর গ্রেফতার করা হয় হাসানের স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০), বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২)। তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। পরে কক্সবাজারের মহেশখালীর বাপের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আনার কলিকে। মূলত শ্বশুর হাসানের লাশ সমূদ্র সৈকতে ফেলে দেন তিনি।
ফলে সেই মাথা উদ্ধারে পুত্রবধূ আনার কলিকে নিয়ে নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকায় তিনদিন ধরে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। মঙ্গলবার (৩ সেপ্টেম্বর) এ তথ্য জানান মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মহানগর ইউনিটের পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খাঁন।
তিনি বলেন, গত রোববার (১ অক্টোবর) ভোরে পুত্রবধূ আনারকলিকে নিয়ে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে যায় ১৫ সদস্যের পিবিআই টিম। জোয়ারের কারণে বেলা গড়াতে ফিরে এলেও বিকেলে ফের গিয়ে তল্লাশি চালানো হয়। এর আগে পতেঙ্গায় টানেলের প্রবেশমুখে একটি পুলিশ বক্স এর পেছনে পাথরের ব্লকের ভেতরে শ্বশুর হাসানের খন্ডিত মাথাটি আছে বলে দেখিয়ে দেন পুত্রবধূ আনারকলি।
সেখানে আমরা কয়েকঘণ্টা তল্লাশি চালিয়েছি। কিন্তু জোয়ার চলে আসার কারণে মাথাটি পাওয়া যায়নি। এরপর সোমবার (২ অক্টোবর) দ্বিতীয় দিনের মতো নিহতের পুত্রবধূ আনার কলিকে নিয়ে এ অভিযান চালানো হয়। কিন্তু সেদিনও আনার কলির দেখানো স্থানে মাথা পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ মঙ্গলবার ভোরেও ভাটার সময় আবারও তল্লাশি চালানো হয়। এখনো পর্যন্ত মেলেনি হাসানের মাথা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ব্লকের ভেতরে কোথাও মাথাটি এখনও আটকে আছে। কারণ সেখানে লাশ পচা দুর্গন্ধ পেয়েছি। এছাড়া লাশ কাটায় ব্যবহৃত ধারালো অস্ত্রটিও উদ্ধার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে পিবিআইয়ের সঙ্গে শ্বশুরের মাথা খুঁজতে যাওয়া আনার কলি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, শ্বশুরকে হত্যায় আমি সরাসরি ছিলাম না। স্বামীর কারণে শুধু সহযোগীতা করেছি। সে হিসেবে আমি দোষি, আমি নির্দোষ সেটা একবারও বলিনি। তখন আমার আবেগ কাজ করেছে, বিবেক কাজ করেনি। তখন যদি আমার বিবেক কাজ করতো, তাহলে এত বড় পাপে নিজেকে জড়াতাম না। কারও কথা না ভাবলেও অন্তত নিজের সন্তানের কথা ভাবতাম। আমি আমার সন্তানের কথা পর্যন্ত ভাবিনি।
একই কথা বলেন আদালতেও বলেন আনারকলি। তিনদিনের রিমান্ড শেষে মঙ্গলবার বিকেলে আদালতে তোলা হয় আনারকলিকে। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে এ জবানবন্দি দেন তিনি। এর আগে একই আদালতে ভুক্তভোগী হাসানের বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আনারকলি বলেন, আমার বাবার বাড়ি মহেশখালী। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় আমার প্রথম বিয়ে হয়। স্বামী মারধর করায় আর সংসার করিনি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সফিকুর রহমান ওরফে জাহাঙ্গীরকে বিয়ে করি। তার ভাইয়ের নাম মোস্তাফিজুর রহমান। আমার শাশুড়ি অসুস্থ থাকায় আমার বাসায় ছিল। ১৯ সেপ্টেম্বর আমার শ্বশুর হাসান আলী আমার বাসায় আসেন। সেদিন তিনি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন।
পরদিন সকালে আমাদের ঘরের পাশের একটা খালি ঘরে আমার শ্বশুর, স্বামী ও ভাশুর মোস্তাফিজ যায়। ওই ঘরের ভিতর তারা কী করেছে আমি সব দেখিনি। আমি একবার লুকিয়ে দেখতে গিয়ে জানালা দিয়ে দেখতে পাই আমার স্বামী শফিক ও ভাশুর মোস্তাফিজ শ্বশুরকে একটা বস্তায় ভরছে। পরে বিকেলে জানতে পারে ওরা আমার শ্বশুরকে মেরে ফেলেছে।
এরপর রাতেই শ্বশুরের লাশ টুকরো টুকরো করা হয়। তখন আমি বাসায় ছিলাম না। তারা লাশের টুকরো করে ব্যাগে ঢুকিয়ে আমাকে ভাত খাওয়ার জন্য ডেকেছিল। পরে আমিসহ স্বামী সফিকুর রহমানের সঙ্গে পতেঙ্গা সি-বিচে গিয়ে লাশের একটি অংশ ফেলে দেয়।
এর আগে পিবিআই টিমের সঙ্গে থাকা আনারকলি সাংবাদিকদের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ঘটনার দিন (২০ সেপ্টেম্বর) সকালে আমি আব্বাকে (শ্বশুর) চা-বিস্কুট দিয়ে আমার শ্বাশুড়ির রুমে চলে যাই। পরে আমি বেরিয়ে পাশের বাসার আন্টির বাসার সামনে বসে দু‘জনে গল্প করতে থাকি। তখন আমার স্বামী সফিকুর এসে আমাকে বলে, আজ তুমি আন্টির রান্না ঘরে রান্না করো। আমি বললাম-বাসায় গ্যাস আছে, আমি আন্টির বাসায় কেন রান্না করব। তখন সে আমাকে বিশ্রি গালি দেয়। আমি আন্টির রুমে চলে যাই।
আন্টি বেরিয়ে আমাদের বাসায় কী হচ্ছে সেটা দেখতে যান। ফিরে এসে বলেন, আমার রুমে নাকি দুই ভাই মিলে আব্বাকে হাত-পা বেঁধে ফেলছে। আমি বের হয়ে জানালা দিয়ে দেখি, দুই ভাই আমার শ্বশুরকে একটা বস্তার ভেতরে ঢোকাচ্ছে। তিনি জীবিত নাকি মৃত সেটা আমি বুঝতে পারিনি। আমি আন্টির বাসায় চলে আসি। তখন আমরা দুজন কান্না করতে থাকি। আমার শ্বাশুড়ি আরেক রুমে ছিলেন, তিনিও কিছুই জানতেন না। আমিও কিছু বলিনি। উনি অসুস্থ মানুষ, এসব শুনে যদি আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন সেজন্য বলিনি।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পিবিআই পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান বলেন, গত ২১ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় নগরীর পতেঙ্গা বোট ক্লাবের অদূরে ১২ নম্বর গেইটে একটি ট্রলিব্যাগ পাওয়া যায়। কফি রঙের ট্রলিব্যাগে ছিল মানব শরীরের দুই হাত, দুই পা, কনুই থেকে কাঁধ এবং হাঁটু থেকে উরু পর্যন্ত অংশ। এ ঘটনায় পতেঙ্গা থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আব্দুল কাদির বাদী হয়ে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
এর দুই দিনের মাথায় ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে নগরীর আকমল আলী সড়কের খালপাড়ে একটি খাল থেকে বস্তাবন্দি অবস্থায় টেপে মোড়ানো শরীরের আরেকটি খন্ড উদ্ধার করে পিবিআই। এছাড়া আঙ্গুলের ছাপ ও নিজস্ব সোর্সের মাধ্যমে নিহত ব্যক্তির পরিচয়ও নিশ্চিত করা হয়। গ্রেফতার করা হয় স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০) ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২)। তাদের পাঁচ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
২৭ সেপ্টেম্বর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বাবাকে খুনের লৌমহর্ষক বর্ণনা দিয়ে মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রায় ২৮ বছর নিখোঁজ থাকার পর দুইবছর আগে পরিবারের কাছে ফিরে আসেন হাসান। ফিরেই তিনি ভিটেমাটি বিক্রি করে দেয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। এ নিয়ে স্ত্রী-সন্তানদের সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে।
২০ সেপ্টেম্বর সকালে হাসান ও তার স্ত্রী, বড় ছেলে মোস্তাফিজুর নগরীর ইপিজেড থানার আকমল আলী সড়কের পকেট গেইট এলাকার জমির ভিলায় ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরের বাসায় ছিলেন। সেখানে বাবা ও দুই ভাইয়ের মধ্যে এ নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। এর মধ্যেই বড় ছেলে তার গলা টিপে ধরলে মারা যান হাসান। ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে দুই ভাই মিলে লাশ গুমের উদ্দেশে সেটি কেটে কয়েক টুকরো করে সেগুলো বিভিন্নস্থানে ফেলে দেন।
এদিকে গত শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) রাতে কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় বাবার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয় ছোট ছেলে সফিকুর রহমান জাহাঙ্গীরের স্ত্রী আনার কলিকে। তবে সফিকুর এখনও পলাতক আছেন। শনিবার আনারকলিকে ওই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতের নির্দেশে তিন দিনের রিমান্ডে নেয় পিবিআই।
পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খাঁন বলেন, আনারকলি সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িত নন, তবে আলামত গোপনের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত উপাদানের যোগানও তিনি দিয়েছেন বলে আমাদের কাছে স্বীকার করেছেন। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী আমরা ঘটনাস্থলের পাশের ভবনের পেছনে ময়লার স্তুপ থেকে হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত ধামাটি উদ্ধার করেছি। এরপর তার দেখানো মতে আমরা পতেঙ্গায় গিয়ে মাথার খোঁজে তল্লাশি চালিয়েছি। হত্যার পরদিন সকাল ৭টার দিকে আনারকলি ও তার স্বামী পতেঙ্গায় গিয়ে পাথরের ব্লকের ভেতরে মাথাটি ফেলে দেন বলে আমাদের জানিয়েছেন।
আনারকলির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পিবিআই পরিদর্শক ইলিয়াস খাঁন বলেন, লাশ কাটার জন্য ধামা, প্লাস্টিকের ব্যাগ ও কসটেপ কিনে এনেছিল আনারকলি। যে ট্রলিব্যাগে লাশের আট টুকরো পাওয়া গেছে, সেটাও আনারকলির। কিন্তু সে দাবি করেছে, হাসানকে খুন এবং লাশ কেটে টুকরো করার ঘটনা সে দেখেনি।
এদিকে আনারকলির স্বামী সফিকুরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে জানিয়ে পিবিআই কর্মকর্তা ইলিয়াস বলেন, মাথা পতেঙ্গায় ফেলে আনারকলি ও সফিকুর এক জায়গায় চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু সফিকুরের সঙ্গে থাকতে অপরাধবোধ ও অস্বস্তি কাজ করছিল তার। এজন্য সে পালিয়ে আনোয়ারা বড়উঠান এলাকায় এক ফুপুর বাসায় চলে যান। ফুপু ঘটনা জানতে পেরে তাকে বের করে দেন। আনারকলি তখন তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে মহেশখালীতে বাবার বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকে শুক্রবার আমরা তাকে গ্রেফতার করি।
এরপর শনিবার তাকে আদালতে সোপর্দ করে সাত দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। আদালত তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) তার রিমান্ড শেষ হচ্ছে। বুধবার (৪ সেপ্টেম্বর) তাকে আদালতে তোলা হবে।