ভোজ্যতেলে ‘তেলেসমাতি’ : রশিদ ছাড়া বিক্রি নয়
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের মূল্য বেড়ে যাওয়াকে ‘সুযোগ’ হিসেবে নিয়ে দেশের বাজারে প্রতিটি স্তরেই দাম বাড়িয়েছেন ‘অতি উৎসাহী’ ব্যবসায়ীরা, যা নিয়ে তাদের অভিযোগও একে অপরের বিরুদ্ধে। সয়াবিন তেল নিয়ে গত কয়েকদিন ব্যবসায়ীদের এমন কার্যক্রমকে ‘তেলেসমাতি’ হিসেবে দেখছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়; যে কারণে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে ক্ষেত্র বিশেষ লিটারে ২০ থেকে ৩০ টাকা বেশি দামে তেল কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে।
মঙ্গলবার ঢাকার পাইকারি-খুচরা দোকানি ও ব্যবসায়ী সমিতির নেতাদের সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বৈঠকে এমন পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে অভিযান ও জরিমানা শেষে এ কারওয়ান বাজারে ভোক্তা অধিকারের কার্যালয়ে হয় এ বৈঠক। আলোচনায় ব্যবসায়ীরা তেলের মূল্য বাড়ানোর জন্য একে অপরকে দোষারোপ করেন। মিল গেইট থেকে বাজারে চাহিদা অনুযায়ী তেল সরবরাহ না করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের।
এসব শুনে অধিদপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, তেল নিয়ে ‘তেলেসমতি’ চলছে। এখন থেকে কোনো স্তরেই পাকা রশিদ ছাড়া কোনো পণ্য বেচাকেনা করা যাবে না। আগামী বৃহস্পতিবার থেকে এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে।
গত ৬ ফেব্রুয়ারি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রতিলিটার সয়াবিন তেল বোতলজাত হলে ১৬৮ টাকা ও খোলা হলে ১৪৩ টাকা এবং পাম তেলের দাম ১৩৩ টাকা নির্ধারণ করে। তবে সম্প্রতি বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের গায়ের মূল্য মুছে ফেলে তা প্রতি লিটার ২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। খোলা তেলও বিক্রি হচ্ছে প্রতিলিটার ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়। সুপার পাম তেল বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।
বৈঠকে কয়েকজন মুদি দোকানি অভিযোগ করেন, পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ীরা তাদের কাছে লিটার ১৪৭ থেকে ১৫০ টাকায় সয়াবিন তেল বিক্রি করছেন। এজন্য কোনো রশিদও দিচ্ছেন না। এরপর মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজমল হোসেন বাবুল বলেন, ডিলাররা দিনের পর দিন মিল গেটে অপেক্ষায় থেকেও তেল বুঝে পাচ্ছেন না। মিল থেকে কারসাজি করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। এসব কারণেই ডিলাররা বেশি দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। এখন দোকান মালিক সমিতি, মৌলভীবাজার ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিনিধি নিয়ে একটা কমিটি করে দেন। সেই কমিটি মিল গেইটে পাহারায় থাকুক, আবার পাইকারি বাজারেও থাকুক। আমরা দেখতে চাই কারসাজি কোথায় হচ্ছে।
মৌলভীবাজারের আরেকজন ব্যবসায়ী বলেন, সারাদেশে প্রতিদিন ২১ হাজার ড্রাম ভোজ্যতেলের প্রয়োজন হয়। আপনারা একটু বিশ্লেষণ করে দেখেন গত চার সপ্তাহে উনারা মিল থেকে কত ড্রাম তেল বাহির করেছেন। তাহলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে।
এক ড্রামে ২০৪ লিটার তেল থাকার কথা থাকলেও অনেক সময় ১৮৬ কেজিও পাওয়া যায় বলে তিনি অভিযোগ করেন। বৈঠকে মিল মালিকদের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না। তবে বুধবার তাদের উপস্থিতিতে আরেক দফা আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
অতিরিক্ত সচিব সফিকুজ্জামান বলেন, খুচরা দোকানিরা বলে যে ডিলাররা দাম বাড়িয়ে দেয়। আবার ডিলারদের কাছে গেলে তারা বলে- মিল থেকে রেসনিং করে দেওয়া হচ্ছে। যে পরিমাণ ডিও বা এসও (সাপ্লাই অর্ডার) নেওয়া হচ্ছে, সেই পরিমাণ পণ্য সময়মত দেওয়া হচ্ছে না। এখানে একটা ব্লেইম গেইম চলছে। খুচরা বলছে পাইকারি, পাইকারি বলছে ডিলার আর ডিলাররা বলছে মিলারদের কথা। আমাদের কাছে সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে যে পরিমাণ তেল আছে, তাতে রোজা পর্যন্ত দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। কিন্তু বাজারে গল্প ছাড়া হচ্ছে যে স্টকে সমস্যা। যুদ্ধ লেগেছে সেই ইউক্রেইনে, সেটার গরম এখন বাজারে নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে। টোটাললি তারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। আমরা এটা হতে দেব না।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, দোকানিদের কাছে কোনো পাকা রশিদ থাকছে না। খুচরায় ধরছি, সে বলছে পাইকারি বাজার থেকে বেশি দামে কিনেছে, পাইকারির কাছে গেলে সে বলছে ডিলাররা বেশি দামে বিক্রি করছে, ডিলাররা বলছে মিলাররা বেশি দামে। কিন্তু আমরা পাকা ভাউচার পাইনি। বাজারে আমরা বেশি বেশি যাচ্ছি। আমরা কিন্তু ভালো ব্যবসায়ীদেরকে ডিস্টার্ব করতে যাচ্ছি না। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আগধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যাচ্ছি। সবকিছুর উদ্দেশ্য হচ্ছে যৌক্তিক দামে যেন বাজার চলে।
মিল থেকে ডিলাররা ডিও বা এসও কিনে সেটা পাইকারি বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি না করে নিজেদের মধ্যে যেভাবে হাতবদল করে কৃত্রিমভাবে দাম বাড়াচ্ছেন সে তথ্যও উঠে আসে আলোচনায়। বেচাকেনার এ প্রক্রিয়া যে অবৈধ, তা জানা ছিল না বলে দাবি করেন কয়েকজন ব্যবসায়ী।
অতিরিক্ত সচিব বলেন, কোনো একটা জায়গায় ঘাপলা হচ্ছে সেটা কিন্তু পরিষ্কার। ডিও নিয়ে বড় ধরনের একটা কাগজ বিক্রির খেলা চলছে। তেলের বাজার গরম। তাই অনেকেই তেল নিয়ে ‘তেলেসমাতি’ খেলায় নেমেছেন। পাকা রশিদ থাকতে হবে বৃহস্পতিবারের মধ্যে। রশিদ ছাড়া মালামাল কিনলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা যায়, বর্তমানে বসুন্ধরা, সিটি, এস আলম, টিকে, মেঘনা গ্রুপসহ মোট সাতটি মিলে প্রায় দুই লাখ টন পরিশোধিত ও অপরিশোধিত ভোজ্যতেল মজুদ রয়েছে। এর বাইরে আরও দুই লাখ টন তেলের এলসি খোলা রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দরে ভেড়ার অপেক্ষায় বঙ্গোপসাগরে নোঙর করে রয়েছে আরও দেড় লাখ টন অপরিশোধিত তেলবাহী জাহাজ। দেশে বছরে ২০ লাখ টন তেলের চাহিদা রয়েছে। সেই হিসাবে বর্তমান মজুদ দিয়ে রোজার সময়টি স্বাভাবিকভাবেই পার করা যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা।
দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়