বিস্মিত রওশন বললেন ‘আমি কিছুই জানি না’
জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন নিজেকে দলের চেয়ারম্যান হিসেবে ঘোষণা করেছেন, গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে এমন একটি ‘প্রেস বিজ্ঞপ্তি’ ছড়িয়ে পড়ে। এনিয়ে দিনভর দলটিতে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও উত্তাপ ছড়ায়। জাপার বনানী কার্যালয়ে থাকা নেতা-কর্মীরা তাৎক্ষনিকভাবে প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশও করেন। এরমধ্যেই রওশন নিজেই বিস্ময় প্রকাশের পাশাপাশি সরাসরি জানিয়ে দেন, এ ধরনের প্রেস বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। এমনকি প্রেস বিজ্ঞপ্তি কারা দিয়েছে, সেটিও জানতে চেয়েছেন তিনি।
জাপার ভেতরে-বাইরে উত্তাপের পাশাপাশি কথিত খবরটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নানামুখী আলোচনা-বিতর্ক।
সন্ধ্যায় বিরোধীদলীয় নেতা রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানান, প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া। মসীহ বলেন, রওশন এরশাদ এই বিজ্ঞপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেন না। নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণার প্রশ্নই আসে না। আমাদেরই কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এটি ছড়িয়েছেন। তাদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছা করলেই নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করতে পারেন না। একটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে হয়।
প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি এমন সময়ে দেওয়া হয়েছে, যখন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের দিল্লি সফরে রয়েছেন। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির আমন্ত্রণে তিন দিনের সফরে ২০ আগস্ট তিনি দিল্লি যান। প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি ভুয়া প্রমাণ হওয়ার আগে এবং এ নিয়ে যখন জাপার ভেতরে-বাইরে ও ফেসবুকে নানা জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে, তখন দিল্লিতে থাকা জি এম কাদের ইত্তেফাককে টেলিফোনে বলেন, ‘যে কেউ চাইলেই তো হঠাৎ নিজেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করতে পারেন না। একইভাবে যে কেউ নিজেকে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারম্যানও ঘোষণা করতে পারেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি ওনার (রওশন) বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। কিছু লোক এসব করে বেড়াচ্ছে। উনি বরং আমাকে বলেছেন—তুমি চেয়ারম্যান হিসেবে দল পরিচালনা করো, তোমার জন্য আমার দোয়া সবসময়ই আছে, দল পরিচালনার জন্য তোমাকে লাগবে।’
খবরটি যেভাবে ছড়ালো
রওশন এরশাদের ‘মুখপাত্র’ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী কাজী মামুনুর রশিদের বেতনভুক্ত একটি প্রেস উইং রয়েছে। হোয়াটসঅ্যাপে এই প্রেস উইংয়ের ‘প্রেস নোট (জাপা)’ নামে একটি গ্রুপ রয়েছে। এই গ্রুপে বেলা ১১টা ৪০ প্রথমে প্রতিবেদন আকারে একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয়। এর পাঁচ মিনিট পর দুটি চিঠি পোস্ট করা হয়। এর একটিতে দেখা যায়, জাপার প্যাডে মঙ্গলবারের তারিখে রওশন নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণা করার প্রেস বিজ্ঞপ্তি, যাতে রওশনের স্বাক্ষরও (সন্দেহজনক) রয়েছে। এতে লেখা ছিল, ‘আমি বেগম রওশন এরশাদ, এমপি জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা কো-চেয়ারম্যান এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, পার্টির সিনিয়র নেতাদের পরামর্শে ও সিদ্ধান্তক্রমে দলের গতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করলাম।’
পোস্ট করা আরেকটি চিঠি ছিল হাতে লেখা। ‘সভার কার্যবিবরণী বহি’ নামের একটি প্যাডে হাতে লেখা হয়, ‘মামলা-মোকদ্দমায় জাতীয় পার্টির চলমান অচলাবস্থা নিরসনে পার্টির চার জন কো-চেয়ারম্যান দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদকে সংকট উত্তরণে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে নিম্নে উল্লিখিত পার্টির চার জন কো-চেয়ারম্যান প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদকে দলের ক্রান্তিকাল মোকাবিলায় অস্থায়ী ভিত্তিতে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব অর্পণ করেন।’ হাতে লেখা এই চিঠিতে জাপার চার জন কো-চেয়ারম্যানের নাম ও তাদের স্বাক্ষর দেখানো হয়। তারা হলেন : এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও সালমা ইসলাম। এছাড়া পার্টির দুই প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্না ও শফিকুল ইসলাম সেন্টুর নাম ও স্বাক্ষরও দেখানো হয়। হাতে লেখা এই চিঠিতে তারিখ রয়েছে গত বছরের ৭ ডিসেম্বর। অথচ, জাপার এই ছয় নেতার সুপারিশটি রওশন গতকাল গ্রহণ করেছেন বলে প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি, যাদের নাম ও স্বাক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে তারা প্রত্যেকেই গতকাল সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ‘বিষয়টি সম্পূর্ণ ভুয়া।’
চুন্নু-বাবলা-সেন্টুর ভিডিওবার্তা
প্রেস বিজ্ঞপ্তিটি গতকাল গণমাধ্যমে ও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু এক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘এটা ফেক নিউজ। জাপার যে কয়জন কো-চেয়ারম্যানের নাম ব্যবহার করে নিউজটি করা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কো-চেয়ারম্যানরা জানিয়েছেন, তারা এমন কোনো সিদ্ধান্তে সহায়তা করেননি। সই দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
জাপা চেয়ারম্যানের প্রেস সেক্রেটারি-০২ খন্দকার দেলোয়ার জালালীর পাঠানো এই ভিডিওবার্তায় জাপা মহাসচিব চুন্নু আরও বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যে কেউ ইচ্ছা করলেই চেয়ারম্যানকে অব্যাহতি দিতে পারে না। গঠনতন্ত্রের বাইরে কেউই কিছু করতে পারবে না। জাপার নেতাকর্মীরা জি এম কাদেরের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ আছেন। জাপা থেকে বহিষ্কৃত কিছু ব্যক্তি ম্যাডামের নাম ব্যবহার করে এমন একটি ফেক নিউজ দিয়েছে। এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি এবং এমন ঘটনার সুযোগ নেই।’ ফেক নিউজে বিভ্রান্ত না হতে সবার প্রতি আহ্বান জানান জাপা মহাসচিব।
জাপার কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা পৃথক ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘রওশন এরশাদ নিজেকে জাপার চেয়ারম্যান ঘোষণার খবরটি সম্পূর্ণ ভুয়া, উদ্ভট ও বানোয়াট। পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের আছেন, থাকবেন। রওশন এরশাদ আমাদের মায়ের মতো, তিনি আমাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক। আমি সবসময়ই বলি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরসহ জাপার সবাই এক সূতায় গাঁথা।’ এই ধরনের ভুয়া প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানোর সঙ্গে জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান বাবলা।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টুও ভিডিওবার্তায় বলেন, ‘খবরটি সম্পূর্ণ ফেক। রওশন ম্যাডাম দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে চিকিৎসার পর গত বছরের ডিসেম্বরে দেশে ফিরলে আমরা অনেকেই তাকে দেখতে চাই। তখন সেখানে একটি রেজিস্টারবুক ছিল, সেখানে সবাইকে স্বাক্ষর করে তারপর দেখা করতে হতো। আমাদের তখনকার সেই স্বাক্ষরকে স্ক্যানিং করে এই জালিয়াতি করা হয়েছে।’
আবারও প্রধানমন্ত্রীকে বিতর্কে জড়ানোর অপচেষ্টা
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শনিবার গণভবনে বৈঠক করেন রওশন এরশাদ। বৈঠকে রওশনের সঙ্গে ছিলেন তার পুত্র ও রংপুর-৩ আসনের এমপি রাহিগর আল মাহি (সাদ এরশাদ), নিজের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহ ও মুখপাত্র কাজী মামুনুর রশিদ। শনিবারের বৈঠকের চার দিনের মাথায় কাজী মামুনের নিয়োগকৃত প্রেসউইং থেকে গতকাল কথিত এই প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়া হয়। আর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পরদিনই রবিবার সাদ, গোলাম মসীহ ও কাজী মামুনসহ রওশনপন্থিরা সভা করে আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেই দলের কাউন্সিল আয়োজনের ঘোষণা দেন। এমনকি রওশনের নেতৃত্বে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে বলেও ঘোষণা দেন তারা।
জাপার দায়িত্বশীল নেতাদের মতে, রওশনের সঙ্গে থাকা এসব লোকজন গণভবনে বৈঠকের চার দিনের মাথায় এমন প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছড়িয়ে মানুষের মধ্যে এমন একটি ধারণা দিতে চেয়েছে যে—এর পেছনে সরকার প্রধানের ইঙ্গিত রয়েছে। এমনকি গণভবনে বৈঠকের পরদিনই নিজেরা সভা করে কাউন্সিলের কথা জানিয়েও তারা এমন একটি বার্তা দেওয়ার অপচেষ্টা করেছে। অথচ, প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে কিছু না জানলেও জাপার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তাকে বিতর্কে জড়ানোর হীন চেষ্টা করা হয়েছে।
এর আগেও রওশনের সঙ্গে থাকা এসব লোক এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন। গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন রওশন। জি এম কাদেরও গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর ডাকে। পরদিন রাতে আচমকা রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন এসব লোক। অবশ্য, ৪৫ মিনিট পর ঘোষণাটি স্থগিতও করা হয়েছিল।
দক্ষিণাঞ্চল অনলাইন ডেস্ক