বিসিবি নির্বাচনে তামিম-বুলবুল নাকি সরকার বনাম বিএনপির লড়াই
এশিয়া কাপে বাংলাদেশ দলের ফাইনালের স্বপ্নে বিভোর সমর্থকদের মাঝে দেশে চলছে আরেক নাটক, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) নির্বাচন ঘিরে হাইভোল্টেজ ড্রামা! ৬ অক্টোবরের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সরকারি হস্তক্ষেপের অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ আর কাউন্সিলর মনোনয়ন নিয়ে টানাটানি পৌছায় আদালতের দরজা পর্যন্ত।
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) জেলা ও বিভাগীয় ক্রীড়া সংস্থার সংগঠকদের আবেদনের পর হাইকোর্ট বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বুলবুলের জারি করা একটি চিঠি ১৫ দিনের জন্য স্থগিত করে। কিন্তু নাটক এখানেই থামেনি! সন্ধ্যায় বিসিবির আবেদনে চেম্বার আদালত হাইকোর্টের সেই রায় ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্থগিত করেন। ফলে অ্যাডহক কমিটির বাইরে থেকে মনোনীত ৫৪ জন কাউন্সিলর বাতিলের নোটিশ এখনো কার্যকর। এর মানে, জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ (এনএসসি) ও বিসিবির চাওয়া মতো জেলা ও বিভাগের অ্যাডহক কমিটির সদস্যদের ভোটে ১০ জন পরিচালক নির্বাচিত হবেন।
আমিনুলের অবস্থান পরিবর্তনে যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার সরাসরি প্রভাব আছে বলে জানা যায়। ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে আমিনুল নিজেও বলেছেন, ‘অসমাপ্ত’ কাজ শেষ করার জন্য এনএসসি থেকে তাঁকে সভাপতির দায়িত্বে থাকতে বলা হয়েছে। এদিকে বিসিবির সাবেক সভাপতি ও বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আলী আসগর লবি আগেই সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, বিসিবির এবারের নির্বাচনে তামিম বিএনপির প্রার্থী। ফলে দুই পক্ষের একজন হয়ে গেছে সরকার পন্থী আরেকজন বিএনপি প্রার্থী।
তামিম বনাম বুলবুলের লড়াই
নির্বাচনে মূল লড়াইটা দুই পক্ষের মধ্যে। একদিকে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের নেতৃত্বে ক্রিকেট কিংবদন্তি তামিম ইকবাল। অন্যদিকে এনএসসি সমর্থিত প্যানেলের নেতৃত্বে আমিনুল ইসলাম বুলবুল। দুজনই সভাপতি পদে লড়ছেন। তামিম ক্লাব ক্যাটেগরি থেকে ভোটার, আর বুলবুল ঢাকা বিভাগ থেকে। দুজনের বিরুদ্ধেই উঠেছে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ। তামিমের প্যানেল অভিযোগ করেছে, বুলবুল জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনারদের ওপর প্রভাব খাটিয়ে ৫৪ জন কাউন্সিলরের মনোনয়ন বাতিল করেছেন। এই নিয়ে ১৮ সেপ্টেম্বর তিনি চিঠি জারি করেন, যা যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও এনএসসির কাছেও পাঠানো হয়। এর আগে ১১ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকেও ডিসি ও কমিশনারদের কাউন্সিলর মনোনয়নের জন্য চিঠি দেওয়া হয়।
তামিমের প্যানেল এই চিঠিগুলোকে হাতিয়ার করে বিসিবি সভাপতি ও এনএসসির বিরুদ্ধে নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তুলেছে। রোববার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকার একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলনে তামিমের প্যানেলের সদস্য বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে নিরপেক্ষ থাকার আহ্বান জানান। তিনি হুঁশিয়ারি দেন, ‘নির্বাচন প্রভাবমুক্ত না হলে বিসিবি ঘেরাওসহ রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করা হবে।’
জবাবে ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া দেশের একটি বেসরকারি টেলিভিশনে পাল্টা অভিযোগ করেন, ‘তামিম ভাইয়ের পক্ষের লোকজন ক্লাবের কাউন্সিলরশিপ দখল করতে মানুষ অপহরণ করছে। বুলবুল ভাইকে ফোন করে নির্বাচন থেকে সরে যেতে বলা হচ্ছে। তাঁকে সামনে রেখে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করা হচ্ছে। জানি না সেটা তামিম ভাই কতটা বোঝাবেন।’
গঠনতন্ত্র নিয়ে বিতর্ক
তামিমের প্যানেল দাবি করেছে, বিসিবির গঠনতন্ত্রে অ্যাডহক কমিটির কোনো উল্লেখ নেই। জবাবে বিসিবি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, গঠনতন্ত্রের ৯.১ ধারা অনুযায়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচিত বা অ্যাডহক কমিটি থেকে কাউন্সিলর মনোনয়নের বিধান আছে। সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মির্জা হায়দারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে বিসিবি জানায়।
২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাউন্সিলরশিপ ফরম জমা নেওয়ার সময় ছিল। সন্ধ্যা ৭টায় খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশের কথা থাকলেও বোর্ড সভা রাত ৯টায় শুরু হয়। নির্বাচনের দিন ঠিক আছে ৬ অক্টোবর।
আদালতের টানাটানি
সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) চারটি জেলার ক্রীড়া সংগঠক (লক্ষ্মীপুর, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ) হাইকোর্টে রিট করেন বুলবুলের চিঠি স্থগিতের আবেদন জানিয়ে। হাইকোর্ট ১৫ দিনের জন্য চিঠিটি স্থগিত করে এবং রুল জারি করে জানতে চায়, কেন এটি অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। কিন্তু কয়েক ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে চেম্বার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন। ফলে অ্যাডহক কমিটি থেকে কাউন্সিলর মনোনয়নের নির্দেশনা কার্যকর রইল।
এই নির্বাচন এখন শুধু ক্রিকেট বোর্ডের নিয়ন্ত্রণ নয়, রাজনৈতিক লড়াইয়ের ময়দানে পরিণত হয়েছে। তামিম ও বুলবুলের এই দ্বৈরথে কে জিতবে, তা নির্ভর করছে কাউন্সিলরদের ভোটের ওপর। ৬ অক্টোবরের নির্বাচন পর্যন্ত এই নাটকের আরো কত মোড় বাকি, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে!