November 24, 2024
আঞ্চলিকলেটেস্ট

বরিশালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ব্যয়ে অসহনীয় চাপে নিম্নবিত্তরা

প্রায় দুই সপ্তাহ আগে দিনমজুর মনিরুল ইসলামের স্ত্রী মুন্নী আকতার (২৪) গ্রামের বাড়িতে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রথমে তাঁকে স্থানীয় একটি বেসরকারি ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে বেশ কয়েক দিনে ১৫ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়ে যায়। এরই মধ্যে মুন্নীর রক্তের অণুচক্রিকা (প্লাটিলেট) কমে ২৫ হাজারে নামে। ১৩ আগস্ট স্ত্রীকে নিয়ে আসেন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তাঁর স্ত্রী এখনো সেখানে চিকিৎসাধীন। ওষুধ ও চিকিৎসার খরচ চালানো নিয়ে তিনি চাপের মধ্যে আছেন।

মনিরুল ইসলামের বাড়ি পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার একটি গ্রামে। তিনি ঢাকার একটি করাতকলে শ্রমিকের কাজ করেন। তাঁর স্ত্রী থাকেন গ্রামের বাড়িতে। সরকারি এই হাসপাতালে আসার পর গত চার দিনে ওষুধ, স্যালাইন, টেস্ট করাতে গিয়ে মনিরুলের আরও ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। এখনো মুন্নী পুরোপুরি সুস্থ নন। তবে বৃহস্পতিবার তাঁর প্লাটিলেট বেড়ে ৫৫ হাজার হয়েছে।

বৃহস্পতিবার দুপুরে আলাপকালে মনিরুল ইসলাম বলছিলেন, সরকারি হাসপাতাল থেকে তিনটি স্যালাইন, প্যারাসিটামল ও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ পেয়েছেন। অন্য সবকিছু বাইরে থেকে কিনতে হয়েছে। তিনি অল্প আয়ের মানুষ। স্ত্রীর ডেঙ্গুর চিকিৎসা করাতে গিয়ে এখন পর্যন্ত তাঁর ২৫ হাজারের বেশি টাকা চলে গেছে। ধারদেনা ও আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় এই ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে এসেও এত চিকিৎসা ব্যয় অসহনীয়।

শুধু মনিরুল নন, তাঁর মতো গরিব ও নিম্নবিত্ত পরিবারের লোকজনকে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসার খরচ বহন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে তাঁরা অসহনীয় চাপের মধ্যে আছেন।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে রোগী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাসপাতাল থেকে মূলত প্যারাসিটামল–জাতীয় ওষুধ ছাড়া এখন আর তেমন কিছু রোগীদের মেলে না। স্যালাইন থেকে শুরু করে অন্য সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।

বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার চাখার এলাকার শাহাদাত হোসেনের স্ত্রী রুবিনা আক্তার (৩৫) সাত দিন ধরে এই হাসপাতালে ভর্তি। শাহাদাত জানালেন, সাত দিনে তাঁর ১২ হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে। প্রতিদিন দুটি করে ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। প্রতিটির দাম ৭০০ টাকা। ডেঙ্গু চিকিৎসা যে এত ব্যয়বহুল আগে জানতেন না। সরকারি হাসপাতালেই এ অবস্থা, সেখানে বেসরকারি হাসপাতালের অবস্থা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বরিশাল বিভাগের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা চলতি মাসে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ১৭ আগস্ট পর্যন্ত এ বিভাগে ডেঙ্গুতে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৩৬। এর মধ্যে আগের ১৬ দিনেই আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৮৪৯ জন। ১৩ আগস্ট এক দিনেই চারজনের মৃত্যু হয়েছে।

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক এস এম মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে স্যালাইনের কোনো সংকট নেই। এখন যে রোগী নতুন ভর্তি হন, তিনি ওই দিন স্যালাইন পান না। এর পরদিন থেকে পান। তবে হাসপাতালে সব ওষুধের সরবরাহ নেই। যা আছে, সেগুলো রোগীদের বিনা মূল্যে দেওয়া হয়। চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, এটা জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্তের ব্যাপার। সরকার প্রতিবছরই চিকিৎসা খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছে। এটা সহনীয় পর্যায়ে আনতে সময় লাগবে।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরের জুনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃতের হার বাড়তে শুরু করলেও তা সহনীয় ছিল। জুলাইয়ে তা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পায়। আর আগস্টের শুরু থেকে তা ভয়ংকর রূপ নেয়। বিভাগে মারা যাওয়া ২৫ জনের মধ্যে ১৪ জনই চলতি আগস্টে মারা গেছেন। চলতি বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে ১০ হাজার ৪৩৫ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত বিভাগে ডেঙ্গু রোগী ছিলেন ৪৩৩ জন। এর মধ্যে মৃত্যু হয় দুজনের। অথচ আগস্টের প্রথম ১৬ দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬ হাজার ৮৫৯ রোগী। জুলাইয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসেন ৪ হাজার ৮৬৭ জন। এ মাসে মৃত্যু হয় ৯ জনের।

বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগের কয়েক বছর আমরা দেখেছি, বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের ঢাকাসহ বড় শহরে ভ্রমণের ইতিহাস ছিল। এবার শুরুতে তা থাকলেও জুলাই থেকে স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হওয়া রোগীরাই হাসপাতালে আসছেন। চলতি মাসে আক্রান্ত ও মৃত্যু ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।’

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এবার প্রত্যন্ত এলাকায় ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশার বিস্তার ঘটেছে। এরই মধ্যে বিভাগের বেশ কয়েকটি গ্রামে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। শহরে ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতা এবং কমবেশি মশা নিধনে উদ্যোগ থাকলেও গ্রামে এটা একেবারেই নেই। তাই বিষয়টি আরও বেশি উদ্বেগের। গ্রামের ডেঙ্গু রোগী বাড়ার পেছনে এটাই মূল কারণ।

বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয়ভাবে যেসব স্থান থেকে নমুনা সংগ্রহ করে এডিস মশার লার্ভার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, তার মধ্যে চিপসের প্যাকেট ও পরিত্যক্ত পলিথিনের ব্যাগ আছে। তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধ করা খুব সহজ কাজ। কিন্তু অবহেলা ও অসচেতনতার কারণে সেটি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধে এখন ব্যক্তি পর্যায়ে সুরক্ষা, সচেতনতা ও সম্মিলিত উদ্যোগের বিকল্প নেই।

বরিশাল সংবাদদাতা

শেয়ার করুন: