March 14, 2025
আন্তর্জাতিক

পাকিস্তানে ট্রেনের যাত্রীদের জিম্মিকারী বিএলএ গোষ্ঠী কারা?

পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে একটি ট্রেনের প্রায় ৪৫০ জন যাত্রীকে জিম্মি করেছে বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) নামের একটি সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীটি বেলুচিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়।

ট্রেন ছিনতাইয়ের ঘটনায় প্রায় ১৫০ জনকে উদ্ধার করেছে সেনাবাহিনী। এছাড়া ২৭ জঙ্গিকে হত্যা করা হয়েছে। অপরদিকে চালকসহ ১০ ট্রেন যাত্রীকে বিএলএর সদস্যরা হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র।

বেলুচ লিবারেশন আর্মি হামলা ও যাত্রীদের জিম্মি করার দায় স্বীকার করেছে। এরপর তারা দাবি জানিয়েছে, এসব জিম্মিকে ফেরত নিতে হলে জেলবন্দি জঙ্গিদের মুক্তি দিতে হবে। যদিও পাকিস্তান সরকার দাবিগুলো প্রত্যাখ্যান করেছে। এরবদলে পাল্টা হামলা চালিয়ে জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা জানিয়েছে, যে  ট্রেনটি ছিনতাই করা হয়েছে এটির নাম ‘জাফর’ এক্সপ্রেস। এটি বেলুচিস্তান থেকে খাইবার পাখতুনখাওয়ার মধ্যে চলাচল করে। আর এতে বেশিরভাগ সময় সেনা ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা চলাচল করে থাকেন। ফলে এই ট্রেনটিতে এর আগেও হামলার ঘটনা ঘটেছে। গত বছরের নভেম্বরের কোয়েটা স্টেশন থেকে ট্রেনটি যখন যাত্রা শুরু করতে যাবে ঠিক তখন আত্মঘাতী বোমা হামলা চালানো হয়। এতে ৩০ জন নিহত হন। এছাড়া জঙ্গিরা বেলুচিস্তানে রেললাইনের বড় অংশ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছিল। এতে জাফর এক্সপ্রেসের চলাচল দুই মাস বন্ধ ছিল। এর আগে গত বছরের জানুয়ারিতে ট্রেনটিতে আরেকটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটিয়েছিল তারা। যেখানে ১৩ জন আহত হয়েছিলেন। তবে এবারই প্রথমবার পাকিস্তানে কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী আস্ত একটি ট্রেন ছিনতাই করেছে। যা পাকিস্তান নয় পুরো বিশ্বেই বেশ বিরল ঘটনা।

কেন বেলুচিস্তানে হামলা বেড়েছে?

বেলুচিস্তান আয়তনের দিক থেকে পাকিস্তানের বৃহত্তম কিন্তু সবচেয়ে কম উন্নত প্রদেশ। এখানে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের বসবাস রয়েছে।

তামা ও গ্যাসসহ অন্যান্য খনিজ ও প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও প্রদেশটি উন্নত হতে পারেনি। কারণ দীর্ঘদিন ধরে এখানকার স্থানীয় মানুষ ও কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে।

বেলুচ লিবারেশন আর্মি পাকিস্তানের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করতে চায়। তাদের দাবি, স্বাধীনতার কথা বলায় এখানকার মানুষকে অপহরণ করা ছাড়াও নিপীড়ন করে কেন্দ্রীয় সরকার।

দীর্ঘদিন ধরে বেলুচের স্বাধীনতাকামীদের সঙ্গে সরকারের যে দ্বন্দ্ব চলছে সেটি আরও জটিল করে দিয়েছে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি)।

এক দশক আগে সেখানে দুই দেশের ৬২ বিলিয়ন ডলারের মেগাডেভেলপমেন্ট প্রকল্প শুরু হয়। যা দ্বন্দ্ব ও উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি করেছে। চীনের এই কর্মযজ্ঞকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে বেলুচের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

এই প্রকল্পের আওতাধীন গদর বন্দরসহ চীনা স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অবকাঠামোর ওপর হামলা চালিয়েছে বেলুচ লিবারেশন আর্মির সন্ত্রাসীরা। এতে অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশপাশি অনেক চীনা নাগরিকও নিহত হয়েছেন।

সাম্প্রতিক সময়ে বেলুচিস্তানে এসব সহিংসতার ঘটনা নাটকীয়ভাবে বেড়েছে। গত মাসে সেখানকার কালাত শহরে এই জঙ্গি গোষ্ঠীর হামলায় অন্তত ১৮ সেনা নিহত হন। এর আগে এক নারী আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর এক সদস্যকে হত্যা করেন।

বেলুচ লিবারেশন আর্মি নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করল কীভাবে?

বিশ্লেষকদের মতে, এই গোষ্ঠীর সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। তারা বলছেন, তাদের প্রতিহত করতে পাকিস্তান সরকার ব্যর্থ হয়েছে। কারণ তারা যে কৌশল অবলম্বন করে সেগুলো পুরোনো। যা বর্তমান সময়ের সঙ্গে যায় না। বিএলএর শক্তি বাড়ার বিষয়টি পাকিস্তান সরকারের ব্যর্থতারই প্রতিফলন প্রদর্শন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ভিত্তিক বেলুচিস্তান বিশেষজ্ঞ মালিক সিরাজ আকবর সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে বলেন, বিএলএ আগে ছোট ছোট আক্রমণ চালাত। অথবা গ্যাসের পাইপলাইনকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে হামলা করত। কিন্তু তারা এখন বড় হামলা চালানো শুরু করেছে। আর এ বিষয়টি দেখাচ্ছে, এই জঙ্গিদের প্রতিহত করার সক্ষমতা পাকিস্তান সরকারের নেই।

তিনি বলেন,”গোষ্ঠীটি একটি যাত্রীবাহী ট্রেনে হামলা চালিয়েছে। তাদের এই ক্রমবর্ধমান সাহস এবং আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছে যে, এত বড় সন্ত্রাসী হামলার পর তাদের ধরে বিচার করা দূরের কথা তো, সরকারের তাদের নিয়ন্ত্রণ করার সক্ষমতাও নেই।”

অপরদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক রফিউল্লাহ কাকর আলজাজিরাকে বলেছেন, “বিএলএ তার কমান্ড কাঠামোকে শক্তিশালী করেছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে যারা আছে তাদের হামলা চালানোর আরও স্বাধীনতা দিয়েছে।”

তিনি আরও বলেন, ” আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র যেসব অস্ত্র ফেলে গেছে সেগুলো সংগ্রহ করেছে বিএলএ। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে তারা আরও মারাত্মক হামলা চালাচ্ছে।”

জঙ্গি গোষ্ঠীটির শক্তি বৃদ্ধি ঠেকাতে ব্যর্থ কেন পাকিস্তান?

গত জানুয়ারিতে, ইসলামাবাদভিত্তিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ইনস্টিটিউট ফর পিস স্টাডিজ (পিআইপিএস) সতর্কতা দিয়ে জানায়, বেলুচিস্তানের পরিস্থিতি “উদ্বেগজনক”। তারা আরও জানায়, গত বছর বেলুচিস্তানে ১৫০টিরও বেশি হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা আগের বছরের তুলনায় ১১৯ শতাংশ বেশি।

এরপর বেলুচিস্তানে বড় সামরিক অভিযানের ঘোষণা দেয় পাকিস্তান সরকার। কিন্তু এই অভিযান কখনো শুরুই হয়নি।

যদিও বেলুচিস্তানে পাক সেনারা বিক্ষিপ্ত অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু সেগুলোতে বেশিরভাগই নিরীহ মানুষ অত্যাচারের শিকার হন।

বেলুচিস্তান বিশেষজ্ঞ মালিক সিরাজ আকবর বলেন, “সরকার বিচারের চেয়ে যেন প্রদর্শনীতে বেশি ব্যস্ত। বিএলএ যখন কোনো হামলা চালায় তারা কয়েকজনকে হত্যা করে, তাদের মরদেহ প্রদর্শন করে। মনে করে এতেই তাদের কাজ শেষ।”

এছাড়া বেলুচিস্তান জটিল পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় বিষয়টিও বিএলএর জন্য একটি সুবিধা বলে মনে করেন এই বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, অঞ্চলটি জটিল হওয়ায় সেখানকার পথঘাট চেনেন না সেনারা। যাদের বেশিরভাগই আসেন পাঞ্জাব অথবা খাইবার পাখতুনখোয়া থেকে। অপরদিকে বিএলএ-এর জঙ্গিরা এ দিক দিয়ে এগিয়ে আছে। এছাড়া পাক সেনাবাহিনী ভুল গোয়েন্দা তথ্যের ভুক্তভোগীও হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বেলুচ জঙ্গিদের পুনরুত্থান রুখতে পারবে পাকিস্তান?

রাজনৈতিক বিশ্লেষক কাকর অবশ্য বলেছেন, শুধুমাত্র ভুল গোয়েন্দা তথ্যের কারণেই যে পাকিস্তানের সেনারা ব্যর্থ হচ্ছে তা নয়। সেনাদের সঙ্গে বেলুচের স্থানীয় মানুষের দূরত্ব থাকার বিষয়টিও এখানে প্রভাব ফেলছে। যারা সেনা এবং সরকারের নিগ্রহের শিকার হয়েছে।

আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরকার ও সেনাদের দূরত্বের কারণেই জঙ্গীরা তরুণদের তাদের দলে টানতে পারছে। তার মতে, এই দূরত্ব ঘোচানো না গেলে, সেখানকার মানুষকে পূর্ণ মর্যাদা না দেওয়া হলে এসব হামলা থামানো যাবে না।

শেয়ার করুন: