September 19, 2024
জাতীয়লেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

পরমাণু শক্তির এলিট ক্লাবে বাংলাদেশ

রাশিয়ার কাছ থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ফ্রেস নিউক্লিয়ার ফুয়েল বা ইউরেনিয়াম পেল বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভার্চুয়াল উপস্থিতিতে বাংলাদেশের কাছে ইউরেনিয়াম আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করে রাশিয়া। এর মাধ্যমে বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারকারী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল বাংলাদেশ।

এর আগে, বিকেল ৩টায় ঈশ্বরদীর রূপপুরের প্ল্যান্ট সাইটে দেশের প্রথম এই পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন শেখ হাসিনা ও ভ্লাদিমির পুতিন। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মহাপরিচালক রাফায়েল গ্রসি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পক্ষে পারমাণবিক জ্বালানির সনদ তুলে দেন রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ।

ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান ঘিরে সাজ সাজ রব ছিল পাবনাজুড়ে। রূপপুর প্রকল্প ও গ্রিন সিটি আবাসিক এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়। প্রকল্প এলাকাজুড়ে বাংলাদেশ ও রাশিয়ার জাতীয় পতাকার পাশাপাশি বিভিন্ন রঙের পতাকা শোভা পাচ্ছে।

এর আগে ২৯ সেপ্টেম্বর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের বিশেষ নিরাপত্তায় রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের ইউরেনিয়ামের প্রথম চালান এসে পৌঁছায়। সেদিন ঈশ্বরদীর তিনটি মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। উৎসুক এলাকাবাসী সড়কের পাশের দোকানপাট, বাসাবাড়ির ছাদ ও দূর থেকে মহাসড়ক দিয়ে ইউরেনিয়ামবাহী গাড়িবহর দেখে উল্লাস প্রকাশ করেন।

২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ। তিন মেয়াদে একটানা প্রায় ১৫ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এখন বাস্তবে রূপ নিয়েছে। দেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্প নির্মাণের ফলে আওয়ামী লীগ সরকার তার আরও একটি নির্বাচনী ইশতেহার পূরণ করলো।

‘বাংলাদেশ পরীক্ষিত বন্ধু’

অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি দেওয়া বক্তব্যে বাংলাদেশকে রাশিয়ার পরীক্ষিত বন্ধু বলে অবিহিত করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি আশা করেন, এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের দ্রুত বর্ধমান অর্থনীতির চাহিদা মেটাবে।

পুতিন বলেন, ‘বাংলাদেশ আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। গত বছর আমরা আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপন করেছি।’

প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করে পুতিন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর পিতার কাজ সম্মানের সাথে এগিয়ে নিচ্ছেন।’

পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির যতদিন থাকবে রাশিয়া এটি পরিচালনায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলেও প্রতিশ্রুতি দেন পুতিন। তিনি বলেন, ‘রোসাটম ২০১৩ সালে এটির নির্মাণ শুরু করে। আমি জোর দিয়ে বলছি, এটির নির্মাণ থেকে শুরু করে পুরো মেয়াদে আমরা সাথে আছি। শুধু নির্মাণই নয়, পুরো লাইফ সার্কেলে আমরা পাশে থাকব।’

রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘এখানে দুইটি ইউনিট থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে। প্রথম ইউনিট থেকে ২০২৪ আর দ্বিতিয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে ২০২৬ সালে। এটি বাংলাদেশের ১০ শতাংশ বিদ্যুতের চাহিদা মেটাবে। এটি একটি বড় সংখ্যা। এই কেন্দ্র বাংলাদেশের দ্রুতবর্ধমান অর্থনীতির চাহিদা মেটাবে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা নির্ভরতা কমাবে। কার্বন নির্গমন কমাবে। এটি সার্বিকভাবে পরিবেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে।’

‘পারমাণবিক কেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করব’

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়া ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জনগণের জন্য আজ গর্ব ও আনন্দের দিন। রাশিয়ান ফেডারেশন ও জনগণকে কৃতজ্ঞতা জানাই। স্বাধীন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে তাঁরা সব সময় সহযোগিতা করেছেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা এই প্রকল্পের পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ওয়াজেদ মিয়াকে পরিচালকের দায়িত্বও দিয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালে যখন আমরা সরকার গঠন করি, সবার জন্য বিদ্যুৎ এ চিন্তা করে কাজ শুরু করি। দেশের জ্বালানিনীতিতে পারমাণবিক নীতি গ্রহণ করি। নিউক্লিয়ার পাওয়ার অ্যাকশন প্ল্যান গঠন করা হয়। পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের জন্য সে সময় আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার (আইএইএ) সহযোগিতা চাই। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা করা হয়। সে সময় কাজ শেষ করতে পারিনি। ২০০৯ এ সরকার গঠন করে আবার প্রকল্প হাতে নেই।’

রাশিয়ার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সরকার প্রধান বলেন, ‘রাশিয়া এটি বাস্তবায়নে এগিয়ে এসেছে। আইএইএ শুরু থেকেই পরামর্শ ও সহযোগিতা দিয়েছে। রুশ ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পুতিনকে ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকেও ধন্যবাদ জানাই। ভারতও আমাদের সহযোগিতা করে যাচ্ছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটির (বিদ্যুৎকেন্দ্র) আমরা শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করব। পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করেছি। স্বাধীন একটি কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে যারা এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। ২০২৪ সালে প্রথম ও ২০২৬ সালে দ্বিতীয় ইউনিট চালু হবে। এটি হবে পরিবেশ বান্ধব, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। পৃথক আইনের মাধ্যমে একটি কোম্পানি গঠন করেছি।’

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের গ্রাজুয়েশন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি উপস্থিত হওয়ায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘রাশিয়া আমাদের পরীক্ষিত বন্ধু। প্রেসিডেন্ট পুতিন উপস্থিত থেকে আমাদের সম্মানিত করেছেন।’

এরআগে, গত ২৮ সেপ্টেম্বর রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালানটি দেশে আসে। এরপর তা কঠোর নিরাপত্তাবলয়ের মধ্য দিয়ে নেওয়া হয় রূপপুরে।

দেশের সবচেয়ে বড় একক প্রকল্প রুপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১ লাখ ৪৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট। রাশিয়ান ঠিকাদার হিসাবে রোসাটম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করে।

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট অনুসারে পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে- আমেরিকা, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া।

একবার পারমাণবিক জ্বালানি পাওয়ার প্ল্যান্টের চুল্লিতে দেওয়া হলে এক বছরের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। এর পরে ফের জ্বালানি দিতে হয়।

২০২১ সালের অক্টোবরে ইউনিটের কাঠামোর মধ্যে চুল্লি স্থাপনের মাধ্যমে রূপপুর ইউনিট-১ প্রায় সম্পন্ন হয়। এটি এআইইএ’র মান অনুযায়ী স্থাপন করা হয়। গত বছরের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লি স্থাপন করা হয়।

শেয়ার করুন: