নীতিগতভাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি: ড. ইফতেখারুজ্জামান
নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে নীতিগতভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি বিধায় ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের যে টার্গেট, তা পূরণ করার সম্ভাবনা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
বুধবার (২৪ ডিসেম্বর) ধানমন্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবি আয়োজিত ‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
সংবাদ সম্মেলনে যৌথভাবে গবেষণা প্রতিবেদনটি পাঠ করেন এনার্জি গভর্ন্যান্সের অ্যাসিস্ট্যান্ট কো-অর্ডিনেটর আশনা ইসলাম এবং কো-অর্ডিনেটর নেওয়াজুল মওলা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্থাপিত সক্ষমতা ২৮,৬১৬ মেগাওয়াট, যার মধ্যে নবায়নযোগ্য অংশের স্থাপিত সক্ষমতা মাত্র ১,৩১৪ মেগাওয়াট। ২০১০-২০২৩ সময়কালে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থের বিদেশি বিনিয়োগ হলেও এর ৯৬.৭ শতাংশ জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক খাতে এবং মাত্র ৩.৩ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ব্যবহৃত হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ১২২১.৪ মেগাওয়াট সক্ষমতাসম্পন্ন মাত্র ১৭টি গ্রিড সংযুক্ত নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রকল্প রয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও কার্বন নিঃসরণের ক্রমবৃদ্ধি প্যারিস চুক্তি, আইএনডিসি এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি) লক্ষ্যমাত্রার বিপরীত পদক্ষেপ এবং আমদানি করা জ্বালানি ও বিদ্যুতের ওপর নির্ভরতা বৃদ্ধি জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। জ্বালানি মিশ্রণে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বর্তমান ক্ষুদ্র অবদান এবং চলমান প্রকল্পগুলোর ধীর অগ্রগতি ২০৫০ সালের মধ্যে ১০০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়ক নয় বলে অংশীজনদের আশঙ্কা রয়েছে। এর আগেও টিআইবির ২০২২ সালের গবেষণায় দাতা ও স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কর্তৃক বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের নীতি করায়ত্ত এবং আমদানিনির্ভর জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের চিত্র উন্মোচিত হয়েছে। ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে লক্ষ্যমাত্রার সাপেক্ষে ন্যায়সংগত রূপান্তরে প্রাতিষ্ঠানিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করাসহ বিদ্যমান নীতি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের ভূমিকা সুশাসনের দৃষ্টিকোণ থেকে পর্যালোচনা করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, জ্বালানি নীতি ও পরিকল্পনাগুলোতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে পর্যাপ্ত অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে না। নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন সংক্রান্ত লক্ষ্যমাত্রার ভিন্নতা ও অসংগতি এবং সমন্বয়হীনতা এ খাতের সময়াবদ্ধ লক্ষ্য অর্জনে বড় চ্যালেঞ্জ। বাস্তবতা, সক্ষমতা ও বিদ্যমান কাঠামোর পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ ছাড়াই একদিকে যেমন জ্বালানি মহাপরিকল্পনায় বিদ্যুৎ চাহিদার উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, অন্যদিকে জ্বালানি মিশ্রণে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সেই লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়নি।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, জ্বালানি পরিকল্পনায় উন্নয়ন অংশীদার কর্তৃক বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট স্বার্থের কারণে কৌশলগতভাবে সরকারের নীতিনির্ধারণ ও পরিকল্পনায় প্রভাব বিস্তারের ঝুঁকি রয়েছে। বাংলাদেশের জ্বালানি খাত জীবাশ্মভিত্তিক নীতির দ্বারা প্রভাবিত এবং এতে অধিক মাত্রায় ভর্তুকি ও ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হয়। অন্যদিকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে প্রণোদনার ঘাটতি ও বেসরকারিকরণের নীতি সামগ্রিকভাবে এই খাতকে কর্পোরেট উদ্যোক্তা কর্তৃক ‘জিম্মি’ করে তোলার ঝুঁকি তৈরি করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের ক্রয় ও দরপত্র প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার ঘাটতি বিদ্যমান। প্রকল্প অনুমোদন, বিবিধ চুক্তি সম্পাদন, বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে নানাবিধ অনিয়ম বিদ্যুতের দাম নির্ধারণে প্রভাব ফেলেছে এবং সার্বিকভাবে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করেছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রযুক্তির জন্য বিদেশ নির্ভরতা প্রবল। এ খাতের উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগের ঘাটতিসহ নানাবিধ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা)-কে দুর্বল করে রাখা এ খাতের প্রসারে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ করে ভূমি ক্রয়/অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মামলা, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নির্যাতনে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলেও বিচার না হওয়াসহ অপরাধীদের দায়মুক্তি প্রদান, যা নবায়নযোগ্য প্রকল্পের উদ্যোক্তাদেরও অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানি প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালীদের মতোই অনিয়ম ও দুর্নীতিতে আরও উৎসাহিত করেছে। সার্বিকভাবে জীবাশ্ম জ্বালানির চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম নীতিগত অগ্রাধিকার পাচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানি; এর রূপান্তর ও প্রসারে নীতিকাঠামোতে যতটুকু নীতি ও আইনি বিধান উল্লেখ আছে সেখানেও দুর্বলতা রয়েছে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনের সক্ষমতার ঘাটতি ও তাদের যথাযথ ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থতা এবং বিনিয়োগ ও অর্থায়নে নানাবিধ ঘাটতিসহ উল্লেখযোগ্যভাবে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, যা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে লক্ষ্যমাত্রার সাপেক্ষে ন্যায়সংগত রূপান্তরে অন্যতম বাধ্য।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশে বর্তমানে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ৯৫ শতাংশর মতো, বিপরীতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ৪ শতাংশের বেশি। অর্থাৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত সব সময় অবহেলিত হয়েছে।
তিনি বলেন, জ্বালানি খাতের নীতি কৌশল ও পরিকল্পনায় অনেক অসংগতি ও অস্পষ্টতা রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতের মহাপরিকল্পনা মূলত জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভিত্তি করে গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে যাচ্ছি এমনটা দেখানোর জন্য ক্লিন এনার্জির ওপরে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, যা পরীক্ষিত নয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এ গবেষণার আওতায় যেসব প্রকল্প পর্যালোচনা করা হয়েছে তাতে সুশাসনের যেসব নির্দেশক রয়েছে, তার সব কয়টিতে আমরা ঘাটতি পেয়েছি। আপনারা জানেন যে বিদ্যুৎ খাত সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও দুর্নীতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে একটি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতেও একইভাবে দুর্নীতি করা হয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণ, ভূমি ক্রয়ের মাধ্যমে সেসব দুর্নীতি করা হয়েছে। মূলত নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে নীতিগতভাবে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতের যে টার্গেট, তা পূরণ করার সম্ভাবনা ক্রমাগত কমে যাচ্ছে।

