দীর্ঘদিন পরামর্শ বিহীন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়ার ভয়াবহতা
যারা প্রয়োজন ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন তাদের ভবিষ্যতে আয়রন, ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়ামের অভাব দেখা দেবে। এমনকি হাড় ক্ষয়, অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা সেই সঙ্গে শরীরে কিছু রোগজীবাণু প্রবেশের সক্ষমতা বেড়ে যাবে।
গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবনে হতে পারে যে ক্ষতি
অনেকেই সামান্য সমস্যায় গ্যাসের ওষুধ খেতে দ্বিধাবোধ করেন না। বাংলাদেশে গ্যাসের ওষুধ খাওয়া হয় অনেক বেশি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কথায় কথায় গ্যাসের ওষুধ গলধকরণ করে এমন আচার কমই আছে।
সাধারণ আলসারের ওষুধ ওমিপ্রাজল বেশিদিন একটানা খাওয়ার ফলে অস্টিওপোরোসিস বা হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি বাড়ে বলে জানা গেছে। ডায়রিয়ার মতো সমস্যা হতে পারে। কমে যেতে পারে রক্তে ক্যালসিয়াম বা ম্যাগনেসিয়াম। হতে পারে বিভিন্ন সংক্রমণ।
পেটের সমস্যায় অনেকে অ্যান্টাসিড-জাতীয় বড়ি বা সিরাপ খেয়ে থাকেন। অ্যান্টাসিডের বিভিন্ন উপাদান ভেদে বিভিন্ন সমস্যা তৈরি হতে পারে। হতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্য অথবা ডায়রিয়া।
অন্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অনেক উপাদানের শোষণ কমে যেতে পারে। অ্যান্টাসিড নিয়মিত খেলে কিডনি পাথরের ঝুঁকি বাড়ে। বয়স্ক ও হৃদরোগীদের জন্য বেশি ম্যাগনেশিয়াম সমৃদ্ধ অ্যান্টাসিড ভালো নয়। যেকোনো অ্যান্টাসিডই অন্য ওষুধের কার্যক্ষমতায় প্রভাব ফেলতে পারে। যারা প্রয়োজন ছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে যাচ্ছেন দিনের পর দিন তাদের ভবিষ্যতে আয়রন, ভিটামিন, ম্যাগনেসিয়ামের অভাব দেখা দেবে। এমনকি হাড় ক্ষয়, অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙে যাওয়ার প্রবণতা সেই সঙ্গে শরীরে কিছু রোগজীবাণু প্রবেশের সক্ষমতা বেড়ে যাবে। এমনকি কিডনিতে মারাত্মক সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
আলসারের ওষুধ বা অ্যান্টাসিড নিজে নিজে বা দীর্ঘদিন খাওয়া ঠিক নয়। এতে হতে পারে নানা সমস্যা।
প্রোটন-পাম্প ইনহিবিটর, এই শ্রেণীর ওষুধগুলি গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ (জিইআরডি) এবং অন্যান্য অ্যাসিড-সম্পর্কিত অসুখে প্রধানত ব্যাবহৃত হয়। এই ওষুধ গুলো এসিড রিফ্লাক্স, পেপটিক আলসার, এবং পাকস্থলীর বিভিন্ন সমস্যায় খুবই কার্যকর হওয়ায় এর ব্যবহার অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ব্যবহার বাড়ার সাথে সাথে এর অপব্যাবহার এবং পরামর্শ ছাড়া লম্বা সময় বা আমৃত্যু ব্যবহার করেই যাচ্ছেন অনেকে। 2010 সাল থেকে, FDA PPI-এর দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহারের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বিভিন্ন নিরাপত্তা সতর্কতা জারি করেছে। দীর্ঘদিন এই ওষুধ গুলো ব্যবহারে কি কি সমস্যা হয়ে থাকে আসুন জেনে নেই:
হাইপারগ্যাস্ট্রিনেমিয়া:
দীর্ঘদিন গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ গ্রহণে হাইপারগ্যাস্ট্রিনেমিয়া হয়ে থাকে। কমপক্ষে ১৫ বছর ধরে যারা এই শ্রেণীর ওষুধ গ্রহণ করে থাকে তাদের এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। হাইপারগ্যাস্ট্রিনেমিয়াতে রোগী ওষুধ বন্ধ করার পর গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা আরো ভয়ানক আকার ধারণ করে। এই সমস্যা এড়াতে ডাক্তারের দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের পরে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খাওয়া বন্ধ করতে হবে।
হাড্ডি ক্ষয়:
স্টাডিতে অ্যাসিড দমন ওষুধ এবং খাদ্য থেকে প্রাপ্ত খনিজ ক্যালসিয়ামের শোষণ হ্রাসের মধ্যে সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে; ওমেপ্রাজল ওষুধ থেরাপির 14 দিন পরেই ক্যালসিয়াম শোষণ 41% পর্যন্ত হ্রাস পেতে পারে। ফলে ক্যালসিয়ামের অভাবে হাড় ক্ষয় হতে শুরু করে, তাই প্রয়োজনীয় সময় পর্যন্ত এই ধরনের ওষুধ গ্রহণের সময় অবশ্যই পরামর্শ অনুযায়ী ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে ও ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার গ্রহণ করতে হবে।
হাইপোম্যাগনেসিমিয়া:
যদিও বিরল, তবু হাইপোম্যাগনেসেমিয়া পিপিআই ব্যবহারের সাথে সম্পর্কযুক্ত এবং জীবন-হুমকি স্বরূপ হতে পারে। এর লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে পেশী দুর্বলতা এবং ক্র্যাম্প, টিটানি, খিঁচুনি, অ্যারিথমিয়াস (বুক ধড়ফড় করা) এবং হাইপোটেনশ (লো প্রেসার), রোগীদের সেকেন্ডারি হাইপোক্যালসেমিয়া এবং হাইপোক্যালেমিয়াও থাকতে পারে। এছাড়া এই ওষুধ দীর্ঘদিন( ৫ বছর বা এর বেশি) ব্যবহারকারীদের হাইপোম্যাগনেসিমিয়ার ঝুঁকি 40% এর বেশি।
ভিটামিন বি 12 এর অভাব:
দীর্ঘমেয়াদী পিপিআই ব্যবহার এবং ভিটামিন বি 12 এর অভাবের মাঝে সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায় এবং তা বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে দেখা যায় কারণ এই শ্রেণীর মানুষের ভিটামিন বি ১২ এর ডেফিসিয়েন্সি বেশি হয়ে থাকে। কিন্তু একটি সঠিক ও সুষম ডায়েটের মাধ্যমে এই অবস্থা দূর করা সম্ভব। অপুষ্ঠ ওবং বয়স্ক রোগীদের তাই নির্দিষ্ট সময় পর পর ভিটামিন বি ১২ চেক করতে হবে।
গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ বলতে মূলত গ্যাস্ট্রাইটিস, গ্যাস্ট্রিক আলসার বা আলসারজনিত বদহজমের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধকেই বোঝায়। ওমিপ্রাজল, ইসোমিপ্রাজল, প্যানটোপ্রাজল, ল্যানসোপ্রাজল, রেবিপ্রাজল, ফেমিটিডিন, অ্যান্টাসিড প্রভৃতি সর্বাধিক প্রচলিত ও বিক্রীত ওষুধগুলোই সাধারণ মানুষের কাছে গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ নামে বেশি পরিচিত। গ্যাস্ট্রাইটিস কিংবা গ্যাস্ট্রিক আলসারে সাধারণত নাভির ওপরে পেটে ব্যথা হয় যা খালি পেটে অথবা ভোররাতের দিকে তীব্র হয়, সঙ্গে গলা-বুক-পেট জ্বলে ও টক ঢেঁকুর ওঠে। ঝাল-তেল-মসলাজাতীয় খাবারে এই সমস্যা আরও বেশি হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে অধিকাংশ সাধারণ মানুষই যেকোনো পেট ব্যথা মানেই গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বলে মনে করেন। আসলে আমাদের দেশে প্রায় ৭০-৮০% মানুষই অপ্রয়োজনে প্রোটন-পাম্প ইনহিবিটর বা অ্যান্টি আলসারেন্ট জাতীয় ওষুধ সেবন করে থাকেন এবং এদের অধিকাংশই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া যখন-তখন এবং টানা দীর্ঘদিন এইসব ওষুধ গ্রহণ করেন। বেশির ভাগ মানুষেরই ধারণা, এইসব ওষুধের কোনো ক্ষতিকর দিক নেই। কিন্তু কোনো ওষুধই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়।প্রোটিন জাতীয় খাদ্য পরিপাক এবং খাবারের জীবাণু ধ্বংসে পাকস্থলীর হাইড্রোক্লোরিক এসিড খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া খাবারের লৌহ শোষণেও এর ভূমিকা অপরিসীম। লৌহ আমাদের রক্তকণিকা ও মাংসপেশি গঠনে এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ও স্নায়ুবিকাশে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধগুলোর মূল কাজ পাকস্থলীর এই এসিড নিঃসরণ কমিয়ে দেওয়া। এতে পাকস্থলীর অমøতা কমে যায়, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা কিছুটা লাঘব হয় কিন্তু বিভিন্ন স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় কাজে ব্যাঘাতও ঘটে। এ ছাড়া শরীরে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়াম শোষণও বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শরীরে বিভিন্ন জীবাণু সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। পাশাপাশি রক্তশূন্যতা, হাড়ের ক্ষয়রোগ, বৃক্কের কার্যকারিতা হ্রাস এবং গ্যাস্ট্রিক পলিপের মতো রোগের আশঙ্কা অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়। পাকস্থলীতে হেলিকোব্যাকটার পাইলোরি নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থাকলে আলসার বা এসিডিটি সহজে সারে না। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট চিকিৎসা আছে, যা রোগ নির্ণয় করে নির্দিষ্ট মেয়াদে গ্রহণ করতে হয়। শুধু প্রোটন-পাম্প ইনহিবিটর জাতীয় ওষুধ খেয়ে গেলে তা আরোগ্য হয় না। আবার দীর্ঘদিন এসিডিটির ব্যথা, হজমের সমস্যা, গ্যাস বা পেট ফাঁপার পেছনে পিত্তথলির সমস্যা কিংবা পাকস্থলীর ক্যানসারের মতো অন্যান্য কারণও থাকতে পারে। এ কারণে গ্যাস্ট্রিকের সমস্যায় বছরের পর বছর গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ খেয়ে যাওয়া কোনো সমাধান নয়। কারণ খুঁজে বের করে তার যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে। অ্যান্টি আলসারেন্ট মূলত পেপটিক আলসারের চিকিৎসায় নির্দিষ্ট মেয়াদে ব্যবহার করার কথা। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম বা নন-আলসার বদহজমের চিকিৎসায় অনেকেই না বুঝে এসব ওষুধ দীর্ঘদিন ব্যবহার করেন। আবার কখনো কখনো কেউ কেউ হুট করে এসব ওষুধ সেবন বন্ধও করে দেন। এতে তারা অতিরিক্ত রিবাউন্ড এসিডিটির সমস্যায় পড়তে পারেন। অন্য অনেক ওষুধের মতো এগুলোও সেবনের যেমন নিয়ম আছে, তেমনি তা ছাড়ারও নিয়ম আছে। তাই গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ সেবন শুরু ও বন্ধ করার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিজের রোগ সম্পর্কে জেনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ওষুধ সেবন করুন ও প্রয়োজন ছাড়া ওষুধ খাওয়া পরিহার করে সুস্থ থাকুন।
সবশেষে যে কথাটা বলা দরকার তাহলো, একটি সঠিক খাদ্যভ্যাস ও সুষম ডায়েটের মাধ্যমে বুক জ্বালাপোড়া, পেট ফাঁপা, বুকে ব্যাথা জাতীয় সমস্যা দূর করা সম্ভব এবং প্রাকৃতিক সকল কিছুই পার্শপ্রতিক্রিয়া মুক্ত। গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ মুড়ির মত না খেয়ে একটি হেলদি ডায়েট মেনে চলুন ও ডাক্তারের দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের পরে পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করবেন না।