তিনি ছিলেন ভারতের শিক্ষিত ও প্রথম অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ ভারতে উদার অর্থনীতির প্রবেশ ঘটেছে তার হাত ধরেই। দেশটির অর্থনীতির বহু আলোচিত ও বহু বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব তিনি। ভারতের ইতিহাসে তিনি প্রথম শিক্ষিত ও এখন পর্যন্ত একমাত্র অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী। তবে প্রধানমন্ত্রী না হলেও ভারতীয় অর্থনীতির কারণে তার নাম থেকে যেত দেশটির ইতিহাসে অনেকটা জায়গা জুড়ে। দেশটির উদার আর্থিক নীতির জনক হিসেবে তিনি স্বীকৃতি পান ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যেই।
বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) রাত ৮টার দিকে দিল্লি এমসে হাসপাতালে মারা যান ৯২ বছর বয়সী সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। কৃতী ছাত্র, নামী শিক্ষক, উচ্চপদে নানা চাকরি থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক পদে উঠে আসা— সব মিলিয়ে মনমোহনের জীবন এক চমকপ্রদ উত্থানের কাহিনী।
চলুন জেনে নিই পাকিস্তানের পাঞ্জাবে জন্ম নেওয়া মনমোহন কোথায়-কীভাবে পড়াশোনা করেছেন এবং হিন্দু না হয়েও যেভাবে হলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী—
মনমোহন সিং ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অবিভক্ত পঞ্জাবের প্রত্যন্ত এক গ্রামে শিখ পরিবারে জন্মেছিলেন মনমোহন সিং। এটি বর্তমান পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের চকওয়াল জেলার গাহ গ্রাম। অল্প বয়সে মাকে হারান। ঠাকুমার কাছেই মানুষ হন তিনি। প্রথমে উর্দু মাধ্যম স্কুলে শিক্ষা। দেশভাগের সময় ১৯৪৮ সালে কিশোর মনমোহন বাবা গুরমুখ সিংহ এবং মা অমৃত কৌরের হাত ধরে শরণার্থী হয়ে চলে আসেন ভারতের অমৃতসরে। এখানে এসে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৮ সালে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
পড়াশোনায় বরাবরই মেধাবী ছিলেন কৃষক পরিবারের সন্তান মনমোহন সিং। চণ্ডীগড়ের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে ১৯৫২ সালে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। জানা যায়, ক্লাসে কখনো দ্বিতীয় হননি মনমোহন।
পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে বিদেশে পাড়ি দেন মেধাবী মনমোহন। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। সেখান থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে অনন্য কীর্তি গড়েন। তারপর ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ‘ডক্টর ফিল’ ডিগ্রিও অর্জন করেন। অসাধারণ ফলাফলের কারণে তিনি ‘স্কলারশিপ’ অর্জন করেন।
দরিদ্র কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা মনমোহনের পরিবারের সামর্থ্য ছিল না তাকে বিদেশে পড়ানোর। প্রতিটা পরীক্ষায় স্কলারশিপ পেয়েই তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। কেমব্রিজে পড়ার সময়, অর্থের অভাব তাকে যথেষ্ট বিচলিত করেছিল বলে একটি বইয়ে প্রকাশ করেছিলেন মনমোহনের কন্যা দমন সিংহ। তিনি লিখেছেন, পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫০ পাউন্ড স্কলারশিপে বছরে ৬০০ পাউন্ড খরচ চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছিল তার বাবার।
মনমোহন নিজেও জানিয়েছিলেন যে, স্কলারশিপের ভরসাতেই তিনি বিদেশে পড়তে পেরেছেন। ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের একটি গণমাধ্যম তাকে প্রশ্ন করলে মনমোহন সিং বলেন, তিনি ‘বৃত্তি ব্যবস্থার পণ্য’। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার জন্য তিনি কীভাবে লন্ডনে যেতে পেরেছিলেন জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি আমাদের বৃত্তি ব্যবস্থার কৃতিত্ব।’
সাক্ষাৎকারে মনমোহন সিং বলেন, ‘আমার হাতে থাকা সম্পদের ভিত্তিতে আমি কখনই অক্সফোর্ড বা কেমব্রিজে যেতে পারতাম না। আমার বাবা-মা আমাকে পাঠাতে পারেননি। কিন্তু আমি পরীক্ষায় ভাল ফল করেছি, তাই বৃত্তি অর্জন করতে পেরেছি। কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে একটি ফেলোশিপ দিয়েছে, তাই আমি বৃত্তি ব্যবস্থার পণ্য।’
এত বিষয় থাকতে অর্থনীতিকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন মনমোহন —এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানিয়েছিলেন, চারপাশে দারিদ্র দেখে বড় হয়েছিলেন তিনি। কেন এত দারিদ্র, ভারত এত দরিদ্র দেশ কেন, এত আর্থিক দুর্দশার কারণ কী, এই প্রশ্নগুলোই তাকে অর্থনীতির দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করে।
বিদেশ থেকে একের পর এক সম্মান ঝুলিতে পুরে দেশে ফিরে তার কর্মজীবন শুরু হয় অধ্যাপক হিসাবে। যোগ দেন রাষ্ট্রপুঞ্জের চাকরিতে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত একটানা রাষ্ট্রপুঞ্জের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শাখায় কাজ করেন।
১৯৬৯ সালে মনমোহন শুরু করেন শিক্ষকতা। দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্সে যোগ দেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য সরকারি দায়িত্বের ক্ষেত্রে প্রবেশ তার। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন। ১৯৭৬ সালে হন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসচিব। ১৯৮০ সাল থেকে টানা দু’বছর মনমোহন ছিলেন প্ল্যানিং কমিশনে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ১৯৮২ সালে মনমোহনকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার গভর্নর করা হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেই পদে ছিলেন। এর পর দু’বছর (১৯৮৫-৮৭) তিনি প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন।
১৯৮৭ সালে অর্থনীতি বিষয়ক স্বাধীন সংস্থা সাউথ কমিশনের মহাসচিব পদে বসেন মনমোহন, যার সদর দফতর সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায়। সেখানেই ১৯৯০ পর্যন্ত ছিলেন মনমোহন। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে আসেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। ১৯৯১ সালের মার্চে তিনি ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান পদে বসেন।
১৯৯১ সালের জুন মাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও তার সরকারে মনমোহনকে অর্থমন্ত্রী করলে বিশ্বের নজরে আসেন তিনি। এটি স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি। এরপর থেকেই দিক পরিবর্তন করতে থাকে ভারতের আর্থিক নীতি বা বাজারনীতি। নরসিংহ রাওয়ের শাসনামলে অর্থমন্ত্রী হিসাবে দেশের আর্থিক সংস্কার কর্মসূচির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছে তার নাম। অর্থনীতির সব গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরিয়ে বেসরকারি পুঁজি, ক্ষেত্রবিশেষে বিদেশি পুঁজিকেও জায়গা করে দেওয়ার রাস্তা তৈরি হয়েছিল মনমোহনের হাতে। পাঁচ বছর অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন বহু বিতর্কের কেন্দ্রে ছিলেন তিনি। একদিকে প্রবল নিন্দা আর প্রতিবাদ, অন্যদিকে দু’হাত তুলে প্রশংসা আর সমর্থন, দুই-ই জুটেছে তার।
১৯৯১ সালে কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার পর কংগ্রেসের হয়ে প্রথম বার রাজ্যসভা সদস্য নির্বাচিত হন মনমোহন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান তিনি। ১৯৯৯ সালে একবার লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জিততে পারেননি।
২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর কংগ্রেস সরকার তৈরি করার মতো জায়গায় পৌঁছয়। কিন্তু ‘বিদেশিনী’ বিতর্কের আবহে প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী। বিকল্প হিসেবে সামনে আসে মনমোহন এবং প্রণবের নাম। কংগ্রেস সভানেত্রীর সমর্থন ছিল মনমোহনের দিকে। শেষ পর্যন্ত সিলমোহর পড়ে মনমোহনের নামে।
নিজের প্রধানমন্ত্রীত্বের প্রায় পুরো সময় ধরেই ভারতীয় অর্থনীতি পরিবর্তনে ব্যস্ত ছিলেন অর্থনীতিবিদ মনমোহন সিং। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ২০০৮ সালে বামেদের বাধা উপেক্ষা করে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। সিপিএমসহ বাম দলগুলোর বিরোধিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকারের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। আস্থাভোটে কোনো রকমে রক্ষা পায় মনমোহনের সরকার।
২০০৯ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনে আসনসংখ্যা আরও বাড়িয়ে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন মনমোহন। সেই সরকারে রেলমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে বাংলা জয়ের পর মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতে মমতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ছাড়েন। তৃণমূলের অন্যান্যরা অবশ্য মন্ত্রিসভায় থাকেন। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে সায় দেওয়ায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহনের সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসে তৃণমূল। মনমোহন অবশ্য নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়েননি।
বিজেপি নেতৃত্ব তার মিতভাষী স্বভাবকে কটাক্ষ করে বার বার ‘মৌনীমোহন’ বা ‘দুর্বল প্রধানমন্ত্রী’ বললেও দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমের কাছে এই ‘সিং’ ছিলেন ‘কিং’।
ভারতের ইতিহাসে মনমোহনই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি আগে নিজের অবসরের কথা ঘোষণা করেছিলেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পাঁচ মাস আগে গোড়ায় মনমোহন ঘোষণা করেন, তিনি তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রীত্বের দৌড়ে নেই। ২৬ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছেড়ে শেষ বারের মতো বেরিয়ে যান মনমোহন। সেই দিনই প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদি।
ভারতের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাস অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী এবং নরেন্দ্র মোদি ছাড়া মনমোহনই দীর্ঘতম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী পদে ছিলেন। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত একটানা ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন তিনি।
শারীরিক অসুস্থতার কারণে গত কয়েক বছর ধরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিলেন তিনি। তবে মিতভাষী মনমোহন বেশ কয়েকবার সরব হয়েছেন মোদি সরকারের আর্থিক নীতি নিয়ে। শুধু সমালোচনাই নয়, পরামর্শও দিয়েছেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ। বিমুদ্রাকরণের পর তিনি জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করেন, এর ফলে দেশের অর্থনীতি এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে চলেছে। কারণ যা-ই হোক না কেন, কোভিড-পর্বের অনেক আগে থেকেই লাগাতার মন্দগতি চলতে থাকে ভারতীয় অর্থনীতিতে। অথচ ২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার সময়ও ভারতের গায়ে কিন্তু বড় আঁচ লাগেনি। কারণ, সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ‘সিংহ’ মনমোহন।
মনমোহন সিং চলতি বছরের জানুয়ারিতে একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে শেষ বার জনসমক্ষে এসেছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই নীল পাগড়ির সর্দারজি ছিলেন ‘লাস্ট অফ দ্য মোহিকান্স’। তার জীবনাবসানে ভারত এক বিরল ভদ্র, শিক্ষিত এবং নম্র রাজনীতিবিদকে হারাল বলেই মনে করছে দেশের রাজনৈতিক মহল।