August 11, 2025
ফিচারলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

ডেঙ্গু চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি

সাবিয়া সিদ্দিকা

ডেঙ্গু এডিস মশাবাহিত ভাইরাস জনিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগ যদিও এটি এখন সব ঋতুতেই দেখা যায়। ডেঙ্গু একটি ভাইরাস, যা Flaviviridae পরিবারের সদস্য। ডেঙ্গুর উপসর্গগুলি- জ্বর, মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রোগটি রক্তক্ষরী রূপ নিতে পারে যাকে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার বলা হয়। এর ফলে রক্তপাত হয়, রক্তে অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং প্লাজমার নিঃসরণ ঘটে। কিছু ক্ষেত্রে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম দেখা দেয়। কয়েক প্রজাতির এডিস মশকী ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রধান বাহক। বিংশ শতকের প্রথমভাগে ডেঙ্গুর ভাইরাস উৎস ও সংক্রমণ বিশদভাবে জানা যায়। WHO বিশটি অবহেলিত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রোগের একটি হিসেবে ডেঙ্গু চিহ্নিত করেছে।
ডেঙ্গুকে আমেরিকায় ব্রেকবোন ফিভার বলে। এটি সংক্রামক ট্রপিক্যাল ডিজিজ, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের কারণে হয়। রোগটি সর্বপ্রথম স্কটল্যান্ডের ডান্ডিতে মহামারী আকারে দেখা দেয়। তাই এ জ্বরকে ডান্ডি জ্বরও বলা হয়। হাড়ভাঙা বেদনা নিয়ে এজ্বর হয়। এ কারনে এজ্বরের নাম হয়েছে ডেঙ্গু জ্বর। ডেঙ্গুর বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা (সাধারণতঃ দু’চোখের মাঝে), মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা এবং র‌্যাশ।ডেঙ্গুর “হাড়-ভাঙা জ্বর” নাম মাংশপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলের ব্যথা থেকে এসেছে। রোগীকে বিশ্রামে থাকতে হবে প্রোটিন ও আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হবে। এসময় শরীর যেন পানিশূন্যতায় না ভোগে, সেজন্য আড়াই থেকে তিন লিটার পানি প্রতিদিন পান করতে হবে। স্যালাইন, স্যুপ, ডাবের পানি, ফলের রস জাতীয় পানীয় প্রচুর পান করা উচিত। পটাশিয়াম, ভিটামিন-ই, ভিটামিন-কে, ফোলেট এবং পেঁপে খাওয়া প্রয়োজন। ডেঙ্গু জ্বরকে ভাইরাল জ্বর ভেবে উপেক্ষা করা ঠিক না। দুটি আলাদা হলেও ডেঙ্গু তুলনামূলকভাবে ভয়ংকর। রোগীদের হজম করা কঠিন এমন খাবার এড়িয়ে চলতে হবে। ধূমপান এড়িয়ে চলুন। স্বাভাবিক স্বাস্থ্য সম্পন্ন একজন প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের প্রতি microliter রক্তে প্লেটলেট সংখ্যা হয় ১৫০,০০০ থেকে ৪৫০,০০০ । ঝুঁকিপূর্ণ ডেঙ্গু-আক্রান্ত রোগীদের এই সংখ্যা ২০,০০০ এর নিচে চলে যেতে পারে। এই সময় রক্তপাতের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হয়। প্লেটলেট কাউন্ট কম এবং রক্তক্ষরণের লক্ষণ প্রকাশ পেলে প্লেটলেট প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হয়। অস্বাভাবিক দুর্বলতা, অসংলগ্ন কথা, অনবরত বমি, তীব্র পেটে ব্যথা, গায়ে লাল ছোপ ছোপ দাগ, শ্বাসকষ্ট, হাতপা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, প্রস্রাবে রক্তপাত, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়া অথবা রোগীর মুখ, নাক, দাঁতের মাড়ি, পায়ুপথে রক্তক্ষরণ, পিরিয়ডে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, রক্তবমি হলে সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
মে-অক্টোবর অর্থাৎ গরম ও বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি। বর্ষা আসলে লার্ভাগুলো থেকে নতুন ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা বের হয়। শহরের উচ্চবিত্ত এলাকাতে বড় বড় বাড়িতে এই মশার প্রজনন বেশি হয়, ফলে সেখানকার বাসিন্দারা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ জানা থাকলে ব্যক্তি নিজেই বুঝতে পারবেন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত কিনা। হাঁপানি রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি ডেঙ্গুর কারণে বৃদ্ধি পায়। ডেঙ্গু ভাইরাস এবং নিউমোনিয়া জীবাণুর একসাথে সংক্রমণ ঘটলে রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠতে পারে। গুরুতর ডেঙ্গুতে রক্তনালীর দেয়ালে (ক্যাপিলারি বা রক্তজালিকা) লিকেজ হয়ে ফুসফুসের অ্যালভিওলাইতে পানি জমতে পারে। ফলে রোগীর শ্বাসকষ্ট ভয়ানক রূপ নিতে পারে। এঅবস্থায় রোগীকে ভেন্টিলেটরে রাখা নাহলে পরিস্থিতি বিপজ্জনক হতে পারে। সময়ের পরিবর্তনে ডেঙ্গুর লক্ষণগুলিও বদলে যাচ্ছে যা জটিলতা সৃষ্টি করছে।বর্তমানে দেখা যাচ্ছে ১ বা ২ দিনের জ্বরেই রোগীর অবস্থার অবনতি ঘটছে। একজন ব্যক্তির সারাজীবনে মোট ৪ বার ডেঙ্গু হতে পারে। কারণ ডেঙ্গু যে ভাইরাসের মাধ্যমে হয় তার ৪টি ধরন। একবার একজন এক ধরনের ভাইরাসে আক্রান্ত হলে দ্বিতীয় বার আর সেই ভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না। অনেকেরই হয়তো ১ বা ২ বার ডেঙ্গু হয়েছে, কিন্তু তারা বুঝতেও পারেনি। তবে ডেঙ্গু রোগ যখন কারো তৃতীয় বা চতুর্থ বার হয় তখন সেটি ভয়াবহভাবে আক্রান্ত করে বা মারাত্মক রূপ ধারণ করে।বর্তমানে যারা ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ১ বা ২ দিনেই সংকটাপন্ন অবস্থায় চলে যাচ্ছেন, তারা সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় বারের মতো ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গু বিষয়ে মানুষের জানা থাকলেও এর প্রকৃতি ও ধরন অনেক স্বাস্থ্যকর্মীর ও বিশদ ধারণা নেই।
ডেঙ্গুর স্তর: ডেঙ্গুকে তিনটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে। যথা- ক্ল্যাসিক্যাল, হেমোরেজিক, শক-সিনড্রোম। ডেঙ্গু ক্ল্যাসিক্যালে প্রথমে প্রচন্ড জ্বর যা ১০৪০-১০৬০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত হয়। জ্বর ২-৭ দিন স্থায়ী হ’তে পারে। সাথে প্রচন্ড মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, বমি ভাব, চোখের পেছনের অংশে ব্যথা, পেশীতে ব্যথা, হাঁড়ের জয়েন্টগুলোতে প্রচন্ড ব্যথা অনুভব এবং শরীরে র‌্যাশ ও চুলকানী হতে পারে।অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে মুখেরমাড়ি, নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হয়, কাশি বা বমির সাথে রক্ত আসে, ইনটেস্টাইনাল হেমোরেজের কারণে কালো পায়খানা হয়, মুখমন্ডল ফুলে যায়, ফুসফুসের মধ্যে পানি জমে, পেটে পানি জমে। রক্ত পরীক্ষা করলে দেখা যায়, প্ল্যাটিলেট কাউন্ট কমে এসেছে। শরীরের বিভিন্ন দ্বার দিয়ে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। ডেঙ্গু শক-সিনড্রোম স্তরে ডেঙ্গু হেমোরেজিক জ্বর, রক্তক্ষরণ ও অন্যান্য উপসর্গের সাথে রোগীর হঠাৎ রক্তচাপ কমে যায়, নাড়ীরগতি বৃদ্ধি পায়, হাত-পা শীতল হয়ে আসে, রোগী নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং মুখমন্ডল ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রক্তক্ষরণের কারণে রক্তস্বল্পতা এবং প্ল্যাটিলেট কমে যাবার কারণে মস্তিষ্কে অক্সিজেন-এর ঘাটতি হওয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটতে পারে।
ল্যাব টেস্ট: বুকের এক্স-রে, ইসিজি, ইকোকার্ডিওগ্রাম, কার্ডিয়াক এনজাইম টেষ্ট, ট্রাপোনিন ওয়ান ইত্যাদি পরীক্ষায় নিশ্চিত হ’তে হবে যে, মায়োকার্ডিটিসে আক্রান্ত হয়েছে কি-না। তা ছাড়াও Blood CBC, NS1, IgM, IgG আরও কিছু পরীক্ষা করতে হবে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা: প্রতিদিন বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। এখন জরুরি হলো জনগণকে সচেতন করা। আতংক তৈরি করা ডেঙ্গুর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা নিরাপদ, প্রাকৃতিক এবং কার্যকর। হোমিওপ্যাথিতে রোগ নয়, রোগীকে চিকিৎসা করা হয়, অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগের পুরো লক্ষণ নির্বাচন করে। লক্ষণসমষ্টি অনুসারে মেডিসিন ব্যাবহৃত হতে পারে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য লিডাম পলাস্টার’। এর কার্যক্ষমতার মধ্যে লক্ষণীয় – মশা, মাছি, বিছা, মাকড়সা, ভিমরুল ইত্যাদির দংশন এর বিষ নষ্টকরতে সক্ষম। কীট পতঙ্গের দংশন, কালোদাগ দূর করে লিডামপল।’ ‘কিটাদি বিশেষত মশার কামড়ে লিডামপল উপকারী। ‘ইদুর, বোলতা, ভিমরুল, মশক ইত্যাদির দংশন বিনষ্টকারী লিডামপল।তাই এটি ডেঙ্গুর প্রতিরোধক হিসেবে প্রয়োগ করা যাইতে পারে। আরও যেসব ওষুধ ব্যবহার হয়, সেগুলো ইউপেটোরিয়াম, রাস টক্সিকোডেন্ড্রন, জেলসিমিয়াম, একোনাইট, বেলাডোনা, ব্রাইয়োনিয়া, আর্সেনিক অ্যালবাম, কার্বোভেজ, সালফারসহ আরো অনেক ওষুধ লক্ষণের উপর আসতে পারে। রোগীর জীবনীশক্তির উপর নির্ভর করে শক্তি ও মাত্রা প্রয়োগ করতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শেই ওষুধ দেয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞ হোমিওচিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যেপদার্থ সুস্থ মানুষের মধ্যে একটি রোগের উপসর্গ সৃষ্টি করে সেই পদার্থ অসুস্থ মানুষের মধ্যে একই ধরনের উপসর্গ নিরাময় করতে পারে; এই মতবাদকে বলা হয় সিমিলিয়া সিমিলিবাস কিউরেন্টার, বা “সদৃশ সদৃশকে আরোগ্য করে”। হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞান ভিত্তিক সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসা পদ্ধতি। হোমিওপ্যাথি রোগের নয় রোগীর চিকিৎসা করে। হোমিওপ্যাথি অ্যান্টিবায়োটিকের আশ্রয় না নিয়ে উপসর্গের ভিত্তিতে চিকিৎসা করে যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম। এটি নিরাপদ, প্রাকৃতিক এবং কার্যকর। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা নিন সুস্থ থাকুন।

শেয়ার করুন: