November 23, 2024
আঞ্চলিক

জাহিদুলের মুখে কুয়েটে ছাত্রলীগের নির্মম নির্যাতনের সেই ঘটনা

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট)’র আবাসিক হলগুলোতে কেউ ভিন্নমত পোষণ করলে ‘শিবির’ ট্যাগ দিয়ে  নিরীহ ছাত্রদের ধরে টর্চার করতো বলে এমন তথ্য জানিয়েছেন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্যাতিত এক শিক্ষার্থী। ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটুক্তির মিথ্যা অভিযোগ এবং শিবির সন্দেহে ছাত্রলীগের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হন ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ওই শিক্ষার্থী জাহিদুর রহমান।

ঘটনার দিন রাতে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসী জাহিদুর রহমানকে প্রথমে ড. এম এ রশিদ হলের ১১৫ নম্বর কক্ষে এবং পরবর্তীতে হলের গেস্ট রুমে নিয়ে দু’দফা তার উপর নির্মমভাবে নির্যাতন করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। শুধু তাই নয় নির্যাতনের পর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাকে শেখ হাসিনা সরকারের আজ্ঞাবহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করে কুয়েটে ছাত্রদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এবং হল প্রভোস্ট ছাত্রলীগের নির্যাতনের হাত থেকে সেদিন তাকে রক্ষা না করে উল্টো তাকে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. মিহির রঞ্জন হালদার জাহিদুর রহমানকে নির্যাতনের ঘটনাটি তাৎক্ষণিকভাবে অবহিত হলেও ছাত্রলীগের নির্যাতনের হাত থেকে তাকে মুক্ত করার কোন ভূমিকাই রাখেননি, উল্টো ছাত্রলীগের ইন্ধনে প্রশাসনিকভাবে এজাহারে মামলার বাদী করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি অফিসার মোঃ সাদেক হোসেন পরামানিক এবং মামলার সাক্ষী করা হয় ড. এম এ রশিদ হলের প্রভোস্ট মোঃ হামিদুল ইসলাম ও সহকারি প্রভোস্ট সুনন্দ দাসকে।

দীর্ঘ ৫১ দিন জেল হাজত থেকে জামিনে বের হয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ভয়ে এবং আতঙ্কে প্রিয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে ভয় পায় জাহিদুর রহমান। নির্মম নির্যাতন আর মিথ্যা মামলায় মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন সে। মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয় তার লেখাপড়া। দীর্ঘদিন সে ভয় আর আতঙ্কে মন খুলে সে রাতের ভয়াবহতার কথা প্রিয় ক্যাম্পাসে এসে বলতে সাহস পায়নি।

জাহিদুর রহমান বলেন, তাদের নির্যাতনে সেদিন আমি বুয়েটের আবরারের মতো মরে যেতে পারতাম। কিন্তু আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজ তাদের বিচার দেখার জন্য।

সোমবার (১৯ আগস্ট) বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের ব্যানারে জাহিদুর রহমানসহ কুয়েটে নির্যাতিত অন্যান্য ছাত্র-শিক্ষক নির্যাতনকারী ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের স্থায়ীভাবে ছাত্রত্ব বাতিলসহ ৫ দফা দাবিতে আয়োজিত মানববন্ধনে জাহিদুর রহমান এ দিন প্রাণ খুলে নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে তার উপর নির্মম নির্যাতনের কাহিনী তুলে ধরেন।

নির্যাতিত জাহিদুর রহমান কান্না জড়িত কণ্ঠে তার বক্তৃতায় বলেন, কুয়েটের আবাসিক হলগুলো ছাত্রলীগের মাদকের আখড়া ছিল। তারা দিনে মাদক সেবন করতো আর রাতে হলের নিরীহ ছাত্রদের ধরে শিবির সন্দেহে টর্চার করত। ২০২২ সালের ১২ সেপ্টেম্বর রাতে ছাত্রলীগের ১০ থেকে ১২ জন সন্ত্রাসী শিবির সন্দেহে আমাকে রুম থেকে ধরে নিয়ে প্রথমে ড. এম এ রশিদ হলের ১১৫ নম্বর কক্ষে নিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। যে যেভাবে পারে আমাকে কিল, লাথি, চড়, ঘুষি মারতে থাকে আর বলতে থাকে তুই শিবির করিস। এ সময় তারা আমার মা, বাপ ভাই-বোন তুলে গালিগালাজ করতে থাকে। তারা আমাকে এস এস পাইপ এবং ক্রিকেট খেলার স্ট্যাম্প দিয়ে পেটাতে থাকে আর বলে বল তুই শিবির করিস। আমি ওদেরকে বলি আমি শিবির করি না। এরপর তারা নির্যাতনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়। পাইপ দিয়ে আমাকে এমনভাবে পেটায় আমি যখন পাগলপ্রায়। আমার চিৎকারে রশিদ হল ভারী হয়ে ওঠে। চিৎকারের শব্দ যেন বাইরে না যায় তখন তারা একটা সাউন্ড বক্স এনে উচ্চস্বরে গান বাজাতে থাকে আর আমাকে পেটাতে থাকে। আমি যাতে সেন্সলেস হয়ে না যায় সেজন্য ওরা আমাকে বালতিতে পানি এনে আমার মাথায় এবং গায়ে ঢালে। গায়ে যত শক্তি আছে ওরা আমাকে মারতে থাকে। মারতে মারতে ওরা ক্লান্ত হয়ে যায়। নেশা করে। এরপর পানি খায়। এক পর্যায়ে আমি ওদের পায়ে ধরলাম। ভাই আমাকে আর টর্চার করেন না, আমি মরে যাব। ওরা বলে শিবিরের স্বীকারোক্তি দিলে তোকে ছেড়ে দেওয়া হবে। সেদিন আমার আত্মচিৎকার রশিদ হলের অনেকেই শুনেছিলো। কিন্তু এদের ভয়ে কেউ আগায় আসতে পারেনি। কারণ যে আগায় আসবে তাকেই ধরে শিবির বলে টর্চার করবে।

এরপর তারা আমাকে হল প্রভোস্টের রুমে নিয়ে বসিয়ে তাদের বানানো একটি স্ক্রিনশট দেখিয়ে বলে তুই বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর নামে কটুক্তি করেছিস। সেখানে হল প্রভোস্ট এবং সিকিউরিটি অফিসার উপস্থিত ছিলেন। আমি শিবির করি বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটুক্তি করেছি এমন স্বীকারোক্তি না পেয়ে তারা সেখান থেকে আমাকে গেস্ট রুমে নিয়ে যেতে চায়। আমি স্যারদের বলি স্যার আমাকে বাঁচান। স্যার আমাকে বলে আমাকে মাফ করো। আমরা পারবো না।

তিনি বলেন, হল প্রভোস্ট, হল প্রশাসন আমাদেরকে রক্ষা করার জন্য নিয়োগ প্রাপ্ত। অথচ তাদের সামনে থেকে নিয়ে একটা ছেলেকে গেস্ট রুমে নিয়ে টর্চার করা হবে অথচ তারা কিছুই বলছে না।

নির্যাতন করার পর তারা পুলিশে খবর দেয়। তারা আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চায়। পুলিশ ওদের কাছে জিজ্ঞাসা করে ওর অপরাধ কি? দাড়ি রাখলেই কি কেউ শিবির হয়ে যায়? পুলিশ আমাকে নিতে রাজি না হলে প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা পুলিশের উপর চাপ দিতে থাকে। হল প্রভোস্ট পুলিশকে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলছি এগুলো ও করেছে। পরে পুলিশ আমাকে না নিয়ে চলে যায়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় অথরিটি আমাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রিজন সেলে রেখে আসে।

পরবর্তীতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমার কোন খোঁজ খবর নেয়নি। এরপর ছাত্রলীগ এবং প্রশাসন মিলে আমার নামে কুয়েটে ছাত্রদের মধ্যে অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন শৃঙ্খলা অবনতির ঘটনোর মিথ্যা অপরাধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকিউরিটি অফিসার সাদেক হোসেন পরামানিক বাদী হয়ে আমার নামে মিথ্যা মামলা দায়ের করে।

মামলার সাক্ষী করা হয় ড. এম এ রশিদ হলে প্রভোস্ট মোঃ হামিদুল ইসলাম ও সহকারী প্রভোস্ট সুনন্দ দাসকে। ওই মামলায় আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমি দীর্ঘ ৫১ দিন জেল হাজতে থাকার পর জামিনে মুক্তি পেয়েছি। আমি দরিদ্র ঘরের সন্তান। অনেক কষ্টে আবার বাবা মা টাকা পয়সা জোগাড় করে আমাকে জামিন করিয়েছে। প্রশাসন এবং ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অন্যায়ভাবে আমার উপর যে জুলুম, নির্যাতন চালিয়েছে অন্তবর্তী কালীন সরকারের কাছে আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই। ভবিষ্যতের কুয়েটের আর কোন নিরীহ ছাত্র এভাবে যেন নির্যাতনের শিকার না হয়।

শেয়ার করুন: