জাপান ফুকুশিমার পানি সাগরে ছাড়ায় মামলার প্রস্তুতি স্থানীয়দের
ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত ফুকুশিমার দাই-ইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ‘তেজস্ক্রিয়’ পানি সাগরে ছাড়া নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে জাপানে। স্থানীয় বাসিন্দা ও মৎস্যজীবীদের সংগঠনগুলো সরকারের এ সিদ্ধান্তকে তাঁদের জীবিকা ও জীবনধারার ওপর মারাত্মক আঘাত হিসেবে দেখছেন। বিরোধিতা করার পরও সরকার সিদ্ধান্তে অটল থাকায় মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান টোকিও বিদ্যুৎ–শক্তি কোম্পানি (টেপকো) গত বৃহস্পতিবার দুপুর থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্রে জমে থাকা পানি সাগরে ছাড়া শুরু করেছে। চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলো বলছে, এই তেজস্ক্রিয় পানি সামুদ্রিক প্রতিবেশ ঝুঁকিপূর্ণ করতে পারে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। যদিও টেপকোর দাবি, পানি ‘দূষণমুক্ত’ করার পরই সাগরে ফেলা হচ্ছে।
ফুকুশিমার পানি সাগরে ছাড়া অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানিয়েছেন স্থানীয়রা। সরকার অবশ্য প্রথম ধাপে ১৭ দিন ধরে পানি ছাড়ার এই সিদ্ধান্ত পুনরায় বিবেচনার কোনো আভাস দেয়নি। যদিও জাপানের পরিবেশ মন্ত্রণালয় আজ শুক্রবার জানিয়েছে, সাগরে ছাড়া পানি ক্ষতিকর কোনো প্রভাব ফেলছে কি না, তা পরীক্ষা করে দেখতে ফুকুশিমা এবং পার্শ্ববর্তী কয়েকটি জেলার অদূরে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছে তারা।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি সাগরে ছাড়ার দিনক্ষণ জানানোর পর গত মঙ্গলবার ফুকুশিমার ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পক্ষে আইনজীবীদের একটি দল সংবাদ সম্মেলন করে। সেখানে আইনজীবীরা জানান, সরকার এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এলে জেলা আদালতে মামলা দায়ের করার জন্য এলাকাবাসীর স্বাক্ষর গ্রহণ শুরু করেছেন। তাঁরা সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে মামলা দায়ের করবেন।
জাপান সরকার ও টেপকোর দাবি, পারমাণবিক চুল্লির গলে যাওয়া জ্বালানি শীতলে ব্যবহৃত এই পানি সাগরে ছাড়ার আগে এর তেজস্ক্রিয় উপাদান সরিয়ে নিতে শোধন করা হচ্ছে। তেজস্ক্রিয় পানির নিরাপত্তা–সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক যেসব মানদণ্ড আছে, তা মেনে দূষণমুক্ত করার কাজ চলছে।
তবে আইনজীবীদের দাবি, নিরাপত্তা শর্তাবলি পুরোপুরি পূরণ করা হয়নি। ফলে এ পানি সাগরে ছাড়া হলে তা স্থানীয়দের জীবনধারার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি ফুকুশিমার মৎস্যশিল্পের ওপর সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে পানি সাগরে ছাড়া স্থগিত রাখার জন্য আদালতের আদেশ প্রত্যাশা করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প তাঁদের সামনে এখন আর খোলা নেই।
এদিকে ফুকুশিমার তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছাড়ার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনগুলো। স্থানীয় মৎস্যজীবী ও মৎস্যজীবী সমিতিগুলোর তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও ফুকুশিমার পানি সাগরে ছাড়ার এমন সিদ্ধান্তে অটল থাকাকে সরকারের ‘বেপরোয়া’ মনোভাব বলছেন তাঁরা।
জাপানের মৎস্য সমবায় সমিতিগুলোর জাতীয় ফেডারেশন এ নিয়ে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, ‘এ নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও এতে করে পানি সাগরে ছাড়ার বিরুদ্ধে আমরা যে অবস্থান নিয়েছি, তাতে কোনো রকমের রদবদল হয়নি।’
ফুকুশিমা ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মিয়াগি ও ইওয়াতে জেলার অধিবাসীর অনেকেই সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। তাঁদের অসন্তোষের কারণ, মাছসহ সাগরে পাওয়া নানা পণ্য বিক্রির সঙ্গে এসব অঞ্চলের অনেক মানুষ জড়িত। এ পানি সাগরে ফেললে তাঁদের পেশা হুমকিতে পড়বে।
মৎস্যসহ সামুদ্রিক সম্পদের জন্য হানসু দ্বীপের উত্তর-পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগর উপকূল বরাবর অবস্থিত এ অঞ্চলের দেশে–বিদেশে বেশ খ্যাতি আছে। ফলে সেখানের অনেকে আশঙ্কা করছেন, তেজস্ক্রিয় এই পানি সাগরে ফেলা হলে তাঁদের পেশার জন্য তা মারাত্মক আঘাত হয়ে দেখা দেবে।
স্থানীয় লোকজনের আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, তার কিছু প্রমাণ জাপানের সংবাদমাধ্যম ইতিমধ্যে পেয়েছে। টোকিওর তোইয়াসু মাছের বাজারের পাইকারি বিক্রেতা সমিতির সভাপতি দেশটির বার্তা সংস্থা কিওদোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, তাঁদের ব্যবসার ওপর ফুকুশিমার বর্জ্য পানি ছেড়ে দেওয়ার ক্ষতিকর প্রভাব ইতিমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। বিশেষ করে বিদেশের বেশ কিছু ক্রেতা লেনদেন স্থগিত রাখায় ক্ষতির পরিমাণ অনেক বড় হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি দাবি করেছেন, সরকার যেন তাঁদের সেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে।
অন্যদিকে ফুকুশিমার পানি সাগরে ছাড়া শুরু করায় চীনেও উদ্বেগ ছড়িয়েছে। দেশটির ক্রেতারা যত বেশি সম্ভব লবণ কিনে মজুত করতে শুরু করেছেন। এ পরিস্থিতিতে রাজধানী বেইজিংসহ চীনের কয়েকটি শহরের কর্তৃপক্ষ খুব বেশি আতঙ্কিত না হতে ক্রেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশে পর্যাপ্ত মজুত থাকায় শিগগির লবণ নিয়ে সংকট তৈরির কোনো কারণ নেই।
চীনের ক্রেতারা আশঙ্কা করছেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তেজস্ক্রিয় পানি সাগরে ছাড়া হচ্ছে। ফুকুশিমার এ পানি চীনের উপকূলে এলে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত লবণে তেজস্ক্রিয় দূষণ ছড়াতে পারে। আর এ কারণে দূষিত হওয়ার আগেই যতটা সম্ভব লবণ মজুত করে রাখতে চাইছেন তাঁরা।
ইন্টারন্যাশনাল ডেস্ক