November 21, 2024
জানার আছে অনেক কিছুলেটেস্ট

জাপানের মানুষজন [Japanese People, 日本人] – প্রফেসর ড. মো: মতিউল ইসলাম

গত সংখ্যায় জাপানিজ সম্রাটদের নিয়ে লেখা হয়েছে। সেখানে ‘Era’-র কথা উল্লেখ করেছিলাম।

১৩। গেনগো (げんごう) [যুগের নাম] {new era begins when a new Emperor ascends the throne} আচ্ছা বলেন তো আজকে বাংলা সনের কত তারিখ? আরবি কোন বছরের কত তারিখ? সাধারণভাবে আমিও মনে রাখিনা! কারণ আমার তেমন প্রয়োজন হয়না!

আমরা বাংলাদেশি বাঙালি। আমাদের সংস্কৃতিগত কারণে বাংলা সনের প্রয়োজন হয়। ঠিক একই সময়ে আমরা বাঙালি মুসলিম। ধর্মিয় কারণে আমাদের আরবি তারিখও প্রয়োজন হয়। এই তো আজ অথবা আগামিকাল আমরা হন্যে হয়ে আরবি তারিখ খুঁজবো, মুসলিমদের দ্বিতিয় বৃহত্তম ধর্মিয় উৎসব ‘ঈদ-উল-আযহা’ উদযাপনের জন্য।

জাপানিজরা নববর্ষ উদযাপন করে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে। কিন্তু আর্থিক-বর্ষ (Fiscal year) অথবা শিক্ষা-বর্ষ (Session) হিসেব শুরু করে এপ্রিলের ১ তারিখ থেকে। অর্ধ-বর্ষ শুরু করে অক্টোবরের ১ তারিখে। বাংলাদেশে আমরা জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে ইংরেজি নববর্ষ (Happy new year) উদযাপন করি, আর এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে (১ বৈশাখ) বাংলা নববর্ষ (বাঙালি সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উৎসব) উদযাপন করি। আর আর্থিক-বর্ষ (Fiscal year) অথবা শিক্ষা-বর্ষ (Session) হিসেব করি জুলাই-জুন ধরে। এ-তো গেলো তারিখ হিসেবের মিল-অমিলের কথা!

এবার একটা গল্প বলি। আমার একজন স্যার গাড়ি কিনবেন বলে জাপান থেকে একটা গাড়ির স্পেসিফিকেশন শিট আনিয়েছেন। সেখানে তারিখ লেখা আছে এভাবে- ‘年29月12日-’। স্যার যথারীতি কনফিউজড হয়ে আমাকে নক করলেন। এই তারিখ বলতে কী বুঝায় জানতে চাইলেন। আমি বললাম এটা ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের ‘-’ তারিখ! জাপানিজরা তারিখ লেখার ক্ষেত্রে আমাদের উল্টো রীতি অনুসরণ করে- আগে বছর, তারপর মাস, সবশেষে দিন (বড় থেকে ছোট) [আমরা ‘দিন-মাস-বছর’ (ছোট থেকে বড়) এই রীতি অনুসরণ করি; আমেরিকানরা ‘মাস-দিন-বছর’ এই রীতি অনুসরণ করে] {কি ভজঘট-রে বাবা!!! }। ঠিকানা লেখার ক্ষেত্রেও জাপানিজরা আমাদের উল্টো রীতি অনুসরণ করে- ‘বিভাগ-জেলা-উপজেলা-থানা-মহল্লা-রাস্তা-বিল্ডিং-বাড়ি-মানুষের নাম’।

এবার আসা যাক ‘২৯’ কেনো লিখলো এই প্রসঙ্গে! জাপানে সম্রাটদের রাজত্বকালের সাথে সাথে ‘era’ –র নাম পরিবর্তিত হয়। এই ‘২৯’-টা হচ্ছে জাপানের ১২৫ তম Emperor ‘Tsugu Akihito’ [ৎসুগু আকিহিতো]-এঁর রাজত্বকালিন ‘Heisei era’-এর নির্দেশক। তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়েছিলো ১৯৮৯ সালে। তখন থেকে হিসেব করে ২০১৭ সাল হচ্ছে তাঁর রাজ্যাভিষেকের ২৯তম বছর। তাই এই ‘Heisei era-২৯’ লেখা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় ও সরকারি সকল নথিপত্রে এই রীতি অনুসরণ করা হয়। সকল জাপানিজ এটা অনুসরণ করেন। শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক ডকুমেন্টস-এ ইংরেজি বর্ষ উল্লেখ করা হয়!

এভাবে ‘মিচিইয়ামা হিরোহিতো’ (Michinomiya Hirohito) সম্রাট থাকাকালীন সময়কে জাপানে ‘Shōwa era’ [১৯২৬ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত] বলা হয়। বর্তমানে ‘Hironomiya Naruhito’ [হিরোনোমিইয়া নারুহিতো]-র সম্রাট থাকাকালীন সময়কে জাপানে ‘Reiwa era’ [২০১৯ সাল থেকে তাঁর বেঁচে থাকা অবধি] বলা হচ্ছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জাপানিজরা এমনটা কেনো করে?!

চাইনিজদের কাছ থেকে জাপানিজরা এই কনসেপ্টটা ধার করেছে! চাইনিজরা বিশ্বাস করতো যে, সম্রাটগণ এতো শক্তিশালী ও ঐশ্বরিক ক্ষমতাপ্রাপ্ত হন যে, তাঁরা সময়ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন [an emperor controls even time]। জাপানিজরা সম্রাটদের সাথে-সাথে ‘era’ পরিবর্তনের এই ধারা চাইনিজদের কাছ থেকে ধার করে আনলেও নিজেদের মতো করে এর পরিবর্তন করে নিয়েছে। ‘Meiji era [1868-1912]’ থেকে শুধুমাত্র সম্রাট পরিবর্তন হলেই ‘era’-র নাম পরিবর্তনের প্রথা চালু করেছে। তার আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগ (natural disaster) অথবা প্রতিকুল ঘটনা (inauspicious event) অনুযায়ী (ঘটনা থেকে বের হয়ে আসার অনুপ্রেরণা অথবা স্মারক হিসেবে) ‘era’-র নাম পরিবর্তনের রীতিও প্রচলিত ছিলো। ‘Era’-র নাম পরিবর্তনের এই সংস্কৃতিকে “গেনগো (げんごう) [যুগের নাম] {new era begins when a new Emperor ascends the throne}” বলা হয়।

১৪। ইএ (いえ) [জাপানের চলমান পারিবারিক ধারা] {continuing family system}

বাংলা সিনেমায় আমরা অনেকবার এরকম ডায়লগ শুনেছি- ‘খোকা, তুই ঐ বেদের মেয়ের ছলনায় ভুলিস না! আমাদের পরিবারের মান-ইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দিস না!’ ঐদিকে বেদের মেয়ের পরিবার থেকে বলছে- ‘চৌধুরী সাহেব, আপনাদের টাকাপয়সা থাকতে পারে! কিন্তু ভালোবাসার জন্য কোনো মন নেই!’ এগুলো হচ্ছে পারিবারিক স্বাতন্ত্র্যের বহিঃপ্রকাশ। সিনেমাতেই শুধু নয়, সত্যিকারের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনেও পারিবারিক স্বাতন্ত্র্যের এই ধারার বহিঃপ্রকাশ বিদ্যমান আছে। বাংলাদেশেও আছে, জাপানেও আছে। কি সুন্দর মিল, তাই না!?

জাপানের চলমান পারিবারিক ধারার [ইএ (いえ)continuing family system] দুইটা ধরণ আছে।

(ক) একই পূর্বপুরুষ থেকে বংশানুক্রমিক পারিবারিক ধারা (kinship group descending from a common ancestor)

(খ) পারিবারিক ব্যবসা, শিল্প, অথবা মার্শাল-আর্ট, ইত্যাদির ধারা (schools of family business, arts, or martial arts, etc.)

বাংলাদেশে অতীতে একসময় বংশের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে। চৌধুরী বংশের মেয়ের সঙ্গে বিয়ে করতে সাধারণ কোনো ছেলের পিঠের চামড়া পর্যন্ত উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে! এইতো এক-পুরুষ আগেই আমার নানা’র বংশের (শেখ) এক মেয়েকে বিয়ে করতে চেয়ে গ্রামের এক ছেলে তার ‘জান’ হারাতে বসেছিলো প্রায়! প্রিয় নাট্যকার ও কথা-সাহিত্যিক ‘হুমায়ূন আহমেদ’ বিখ্যাত ‘বহুব্রীহি’ নাটকে দেখিয়েছেন চশমা না-পরতে পারলে কীভাবে ‘সৈয়দ’ বংশের মান-ইজ্জত চলে যাচ্ছিলো!

ব্যক্তিগত যোগ্যতার চেয়েও ‘বংশীয়’ ও ‘পারিবারিক’ যোগ্যতার প্রয়োজন হতো বেশি, বিশেষ করে কোনো সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনের বেলায়। লোক মুখে শুনেছি- ব্রিটিশ আমলে না-কি সিভিল-সার্ভিসে ফাইনাল এপয়েন্টমেন্ট দেওয়ার আগে প্রার্থীর বংশ পরিচয় যাচাই করা হতো (সত্য-মিথ্যা জানি-না!)। এই সব দেখেশুনেই বোধহয় কবি বাধ্য হয়ে লিখেছিলেনঃ “নহে আশরাফ আছে যার শুধু বংশ পরিচয়, সে-ই আশরাফ জীবন যার পুণ্য কর্মময়।” বাংলাদেশের নিকট অতীতে যেমন ‘বংশ-বংশ’ প্রভাব ছিলো, সামন্ততান্ত্রিক জাপানেও (Feudal Japan) একইরকম (সামান্য পরিবর্তিত রূপে) ‘বংশ-বংশ’ ধারা বহমান ছিলো। বংশের প্রভাব বাংলাদেশে অনেকাংশে কমে এসেছে; আর জাপান থেকে প্রায় উঠে গেছে। কিন্তু, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে বিশেষ কিছু প্রেক্ষিতে এই ধারা জাপানে এখনও টিকে আছে, এবং এটাই হচ্ছে (ক) ধরণের “[ইএ (いえ)continuing family system” বৈশিষ্ট্য।

জাপানে থাকাকালীন একটা সমস্যার কথা শুনেছিলাম। সমস্যাটা হচ্ছে- জাপানের প্রাইভেট হসপিটাল গুলো, কৃষি-খামার গুলো আস্তে-আস্তে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে! জিজ্ঞাসা করেছিলাম- ‘কেনো এমন হচ্ছে?’। জানতে পারলাম- এগুলো সাধারণতঃ পারিবারিক কর্মকান্ড (ব্যবসা) হয়। এখন প্রাইভেট হসপিটাল মালিকের ছেলে যদি ডাক্তার না-হতে পারে, তাহলে তার পিতার মালিকানাধীন হসপিটাল চালাবে কে? কৃষি-খামার এর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই কথা (খ) [পারিবারিক ব্যবসা, শিল্প (চারু, কারু অথবা বিনোদন), অথবা মার্শাল-আর্ট, ইত্যাদির ধারা (schools of family business, arts, or martial arts, etc.)] ধরণের “[ইএ (いえ)continuing family system” বৈশিষ্ট্য। এটাও আমাদের দেশের ক্ষয়িষ্ণু পারিবারিক পেশাভিত্তিক বংশানুক্রমের সাথে হুবহু মিলে যায়। যেমনঃ তাঁতি (কাপড় বোনা) [কোথাও কোথাও ‘জোলা’ বলে], কলু (তেল ব্যবসায়ী) কামার, কুমার (মাটির বাসনকোসন বানানো), ইত্যাদি কাজ/ঐতিহ্য পারিবারিক বংশানুক্রমের ধারা বিঘ্নিত হওয়ায় ধীরে-ধীরে উঠে যাচ্ছে (অবশ্য এর সাথে আমাদের জীবনযাপনের ধরণ বদলে যাওয়াটাও সংশ্লিষ্ট)।

যাক, একটা জায়গা অন্ততঃ পাওয়া গেলো যেখানে জাপানের সাথে আমাদের অনেক মিল আছে।

১৫। কামোন (かもん) [পারিবারিক প্রতীক] {family symbol representing one’s family lineage}

আমার একজন প্রিয় ছাত্র আছে। ক্রিয়েটিভিটির জন্য সে আমার খুব প্রিয়। সে অসাধারণ অ্যাম্বিগ্রাম [‘ambigram’- a calligraphic design having two or more (clear) interpretations as written words] ডিজাইন করতে পারে। ভাবছি আমার নামের একটা ‘অ্যাম্বিগ্রাম’ করে দেওয়ার জন্য ওকে অনুরোধ করবো। সরাসরি নাম ধরে প্রশংসা শুনলে আমার নিজের খুব ‘বিব্রত’ লাগে। নাম ধরে তিরস্কার শুনলেও মাথায় ‘খুন’ চড়ে যায়! তাই ছাত্রের নাম উল্লেখ করার রিস্ক নিলাম না আর-কি!  যখনই জাপানের ‘কামোন (かもん)’ গুলো দেখি তখনই আমার ওর কথা মনে পড়ে, যদিও ‘অ্যাম্বিগ্রাম’ আর ‘কামোন’ এক জিনিস নয়!

তাহলে ‘কামোন’ কী?

‘কামোন’ হচ্ছে এমন একটি কুলচিহ্ন (ক্রেস্ট; ডিকশনারিতে Crest এর বাংলা পেলাম ‘কুলচিহ্ন’) যা দিয়ে জাপানে একজন মানুষের বংশের উৎস বোঝায়, উত্তরাধিকারের ধারা বোঝায়, রক্তের সম্পর্ক বোঝায়, পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য ও সামাজিক-অবস্থা (status) বোঝায় [(পারিবারিক প্রতীক) {family symbol representing one’s family lineage}]। এর প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘মোন্দোকোরো (Mondokoro)’ অথবা শুধু ‘মোন (Mon)’। জাপানে ২০,০০০ এর বেশি চিহ্নিত আলাদা-আলাদা ‘কামোন’ আছে।

জাপানিজরা ফর্মাল ড্রেস ‘কিমোনো’-র পেছনে নিজের পরিবারের ‘কামোন’ অংকিত করে। কবর/সমাধির পাথরে ‘কামোন’ অংকিত করে। অনেক সময় নিজের প্রিয় কোনো জিনিসেও ‘কামোন’ অংকিত করে। এটার দ্বারা একটা পরিবার, একটা বংশ অথবা একটা ক্ল্যান (A clan is a group of people united by actual or perceived kinship and descent) আরেকটা থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত হয়। জানা যায় যে, Heian period (794-1185) থেকে Aristocrat-দের দ্বারা ‘কামোন’  এর কনসেপ্ট চালু হয়েছে; আর Edo period (1603-1867)-এ সাধারণ মানুষের ভেতর ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অতীতকালে ‘সামুরাই’-দের আলাদা আলাদা ‘কামোন’ ছিলো [ছবি]! জাপানে যখন প্রত্যেকের পারিবারিক নাম (family name) ছিলো না, তখন একটা পরিবার, একটা বংশ অথবা একটা ক্ল্যান থেকে আরেকটাকে এই ‘কামোন’ দিয়ে আলাদা করা হতো। সরকারী বিভিন্ন সংস্থারও আলাদা-আলাদা ‘কামোন’ আছে [ছবি]।

জাপানের ‘কামোন’-এর সাথে ইউরোপের ‘European heraldic device (The devices are similar to the badges and coats of arms in European heraldic tradition, which likewise are used to identify individuals and families) [ছবি]’ এর মিল আছে। তবে দু’টো জিনিস হুবহু এক নয়।

১৬। গোসেনজো-সামা (ごせんぞさま) [পূর্ব পুরুষ] {cherish their ancestors}

আমরা বড়দের দেখলে সম্মান করি, সালাম দিই, চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াই, বাস-ট্রেনে মুরুব্বী কাউকে দেখলে জায়গা ছেড়ে দিয়ে তাঁদেরকে বসতে দিই। সাইকেল চালানোর সময় কোনো শিক্ষককে সামনে থেকে আসতে দেখলে সাইকেল থেকে নেমে সালাম দিয়ে তাঁর চলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তারপর আবার সাইকেল চালিয়ে গন্তব্যে যাই। আচ্ছা আমি কি বাড়িয়ে বলছি, অথবা ‘ভুল’ বলছি!? একটা হিসেব বলে ২৫ বছরে এক জেনারেশন হয়! এক জেনারেশন আগে হলে “ভুল বলা” “সঠিক বলা” টাইপের প্রশ্ন করতাম না! সে আচরণ তো আমি নিজেই চর্চা করে এসেছি। এখনকার বাস্তবতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই!!

জাপানিজরাও বড়দের সম্মান করেন। পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যদের আলাদা মর্যাদা দেন। পরিবারের পূর্বপুরুষ, যাঁরা ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁদেরকে খুবই শ্রদ্ধা করেন, সম্মান জানান, মর্যাদা দেন। শ্রদ্ধা-সম্মান-মর্যাদা প্রকাশের জন্য বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা করেন। প্রতিদিন করেন।

আচ্ছা, আপনি আপনার মৃত দাদা-দাদী/ নানা-নানীকে শেষ কবে মনে করেছেন বলেন তো?! তাঁদের জন্য আলাদা করে দোয়া শেষ কবে করেছিলেন তা-কি মনে আছে?!

আমি একটা ট্রাডিশনাল জাপানিজ পরিবারের কথা বলবো। জাপানের সাগা প্রিফেকচারের মিয়াকি উপজেলার মিয়াকি ওয়ার্ডের একটা পরিবার হচ্ছে আমার ‘জাপানিজ ফ্যামিলি’। ঐ পরিবারে আমার এক বন্ধু, একজন ছোটভাই, আর জাপানিজ মা-বাবা আছেন। ঐ পরিবারের বাড়িতে আমি দেখেছি একটা হলরুম আছে। রুমটিতে পরিবারের পূর্বপুরুষদের ছবি আছে (যাঁদের ছবি পাওয়া গেছে অথবা রাখা সম্ভব হয়েছে তাঁদের সবার)। ঘরের কোণায় একটা বড় Worship stage আছে। সেই Worship stage-টাকে জাপানিজ ভাষায় ‘বুৎসুদান’ বলে। প্রতি বেলায় রান্না হওয়া খাবারের প্রথম ‘বাটি’ সেই বুৎসুদানে রেখে, প্রদীপ (অনেকটা আগরবাতির মতো) জ্বালিয়ে, টুং করে একটু আওয়াজ তৈরি করে (ঘণ্টা বাজানো নয়, একটা স্প্যাচুলা দিয়ে একটা বাটিকে আঘাত করে শব্দ তৈরি করে), বুৎসুদানের সামনে হাঁটু ভাঁজ করে বসে পরিবারের কেউ না কেউ পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে এসে তারপরে খেতে বসে। পরিবারের পূর্বপুরুষদের জাপানিজ ভাষায় “গোসেনজো-সামা (ごせんぞさま)” বলা হয়। গোসেনজো-সামা (ごせんぞさま)-দের আন্তরিক সম্মান (cherish their ancestors) জানানো জাপানিজ পারিবারিক সংস্কৃতির একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

‘গোসেনজো-সামা’ দেরকে সবসময় পরিবারের অংশ মনে করা হয়। ‘গোসেনজো-সামা’ দেরকে জাপানিজরা ঈশ্বর অথবা দেবতার মতো করে Worship করে। কিছু কিছু জাপানিজ মানুষ মনে করে যে, পূর্বপুরুষগণ ঈশ্বর অথবা দেবতার চেয়েও কাছের, কারণ তাঁরা নিকট অতীতে পরিবারেই সশরীরে বিরাজমান ছিলেন। ‘গোসেনজো-সামা’ দের জন্য এই Worship ধারণা এসেছে তিনটা ধর্মীয় মতবাদ থেকে- শিন্তৌ, বৌদ্ধ ও কনফুসিয়ান।

টাইমিংটা একদম পারফেক্ট হয়েছে! ঠিক একমাস পরেই জাপানে ‘Obon (お盆) or just Bon (盆)’ ফেস্টিভ্যাল শুরু হবে [১৩-১৬ আগস্ট, ২০২১ খ্রি.; কিছু স্থানে ভিন্ন সময়েও উদযাপন করা হয়]। ‘Obon’ is a Japanese Buddhist custom to honor the spirits of one’s ancestors. এই সময় জাপানিজরা সবাই যার যার বাড়িতে চলে আসে। বাড়িঘর সুন্দর পরিপাটি করে সাজায়-গোছায়। বাড়ির মূল প্রবেশ পথে ‘আলো’ অথবা ‘আগুন’ জ্বেলে রাখে। যাতে পরিবারের মৃত পূর্বপুরুষেরা দূর থেকে বাড়ি চিনে ‘ঘোড়া’য় চড়ে তাড়াতাড়ি বাড়িতে চলে আসতে পারে। আর ‘গরু’র পিঠে চড়ে ধীরে ধীরে আবার ফিরে যেতে পারে। এজন্য শশা দিয়ে প্রতীকী ঘোড়া, আর বেগুন দিয়ে প্রতীকী গরুর প্রতিকৃতি তৈরি করে। মৃত পূর্বপুরুষদের সমাধিগুলো পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করে। ছেলেরা ‘ইউকাতা’ আর মেয়েরা ‘কিমোনো’ পরে। পূর্বপুরুষদের ফিরে আসার আনন্দে ‘Bon Odori’ নাচ করে। This Buddhist–Confucian custom has evolved into a family reunion holiday during which people return to ancestral family places and visit & clean their ancestors’ graves when the spirits of ancestors are supposed to revisit the household altars. গত ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে জাপানিজরা পরিবারের পূর্বপুরুষদের বার্ষিক এই স্মরণোৎসব পালন করে আসছে। পরবর্তীতে কোনোদিন শুধুমাত্র এই ‘Obon’ ফেস্টিভ্যাল নিয়ে আলাদা করে গল্প বলবো।

জাপানিজ মানুষদের অথবা মানুষ সংশ্লিষ্ট ১৬ টি সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলা শেষ! ধৈর্য ধরে যাঁরা পড়েছেন, তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

আপনাদের জন্য শুভ কামনা।

 

শেয়ার করুন: