জাপানের মানুষজন [Japanese People, 日本人] – প্রফেসর ড. মো: মতিউল ইসলাম
১। ওয়া (わ) [ঐকতান] {harmony of the Japanese mentality}
পৃথিবীতে যত মানব জাতি আছে তাদের সবকটিই স্বকীয়তায় ভিন্ন ভিন্ন। আমরা একরকম, অন্যরা আরও ভিন্ন রকম! আমরা কর্মঘন্টায় চা খাই, গল্প করি, আড্ডা দিই; বাসায় এসে কাজ করি! কর্মদিবসে ফাঁকি দিই, ছুটির দিনে কাজ করি! লকডাউন দিলে বাইরে বের হতে আঁকুপাঁকু করি! চান্স পেলে বেশি ঘুমাই। পরীক্ষার মৌসুমে, অথবা পরীক্ষার আগের রাতে কোনো ঘুমাঘুমির কারবারই রাখি না! ভাবি এক রকম, বলি ভিন্ন রকম, আর কাজ করি তৃতীয় আরেক রকম! আমিও এর ব্যতিক্রম নই। চিন্তা-ভাবনা, বলা আর করা এর মধ্যে কোনো ঐকতান নেই [exception থাকতে পারে]! কিন্তু জাপানিজদের ক্ষেত্রে এই ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
জাপানের সব মানুষ একই টিউনে টিউনড! Harmony [ঐকতান] তাদের চরিত্রের অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। ওয়া (わ) এর সরাসরি শাব্দিক অর্থ করা মুশকিল। এই ঐকতান যেমন তাদের চিন্তা-কথা-কাজ এর মিল, তেমনই এর আরও একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্যপূর্ণ অর্থ আছে!
অন্য মানুষ কেমন করে ভাবছে, কী বলছে, কী করছে, এগুলোকে সবাই একইভাবে মূল্যায়ন করে ও আমল দেয়। সাচিকো হোরিগুচি ইংরেজিতে এমনটা বলছেনঃ “In the area of human relationships, wa(わ)is considered to exist when you determine your policy in harmony with others.” জাপানিজদের এই গুণটা অনুধাবন ও চর্চা করা কঠিন। বিশেষ করে আমরা যারা ‘স্বাধীনতা’-য় [আমার যা ইচ্ছা তা-ই করবো, তাতে তোর বাপের কি?!] বিশ্বাস করি তাদের জন্য এই কনসেপ্ট মাথার উপর দিয়ে যাওয়ার কথা!
আমি বাদে অন্য মানুষও যে আমাদের চারপাশে আছে তাদের কথা “কিছু পাওয়ার বেলায়”, “কিছু করার বেলায়” আমরা একেবারে ভুলে যাই! অন্যের অধিকারকে সম্মান করা, অন্যের স্বাধীনতাকে চর্চা করার সুযোগ দেওয়া, আর্তের পাশে দাঁড়ানো, অসহায়ের সেবা করা, আইন ও বিচার সবার জন্য সমভাবে লভ্য ও প্রয়োগ করা, সবার জন্য সমান সুযোগ বহাল রাখা, এ সবই “ওয়া (わ)Harmony [ঐকতান]” এর উদাহরণ।
জাপানিজদের এই জিনিসটা ওয়া-ফু (Wa-fuu) [わふう], মানে “জাপানিজ স্টাইল”, হিসেবে সমাদৃত ও চর্চিত!
জাপানের মানুষজন [Japanese People, 日本人]
২। মুজো (むじょう) [ক্ষণকালীনতা] {sentiment in the face of the changes of the seasons}
জাপানে আমার রিসার্চের দুইজন সুপারভাইজার ছিলেন। একজন আকিহিরো নোসে (সেন্সে), আরেকজন তেই শোকি (সেন্সে)। প্রথমজন রিটায়ার্ড হয়ে যাওয়ার সময় আমাকে দ্বিতীয়জনের হাতে তুলে দিয়ে গেলেন। আকিহিরো নোসে সেন্সে রিটায়ার করার সময় জাপানের রীতি মোতাবেক তাঁর সমস্ত কর্মজীবনের ফিরিস্তি তুলে ধরে একটা প্রেজেন্টেশন (Last lecture) দিলেন। তিনি ছিলেন ফটোসিন্থেসিস বিশেষজ্ঞ। তিনি ডালে-ডালে বা পাতায়-পাতায় চলতেন না! তিনি চলতেন পাতারও ভেতরের প্লাস্টিডে, মাইটোকন্ড্রিয়ায়, রুবিস্কোতে… গন্ডা-গন্ডা পাবলিকেশন্স-প্যাটেন্টস, ডজন-ডজন ছাত্রছাত্রী [সরাসরি সুপারভাইজড ল্যাব স্টুডেন্টস (আন্ডারগ্র্যাড, মাস্টার্স অথবা পিএইচডি)] আর শত-শত হাজার-হাজার সুহৃদে ভরা তাঁর কর্মজীবন। তাঁর লাস্ট লেকচারে জাপানের বিভিন্ন কোণা থেকে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা [আমার একজন স্যার বলেন, ছাত্রছাত্রীরা কখনও সাবেক হয়না, শিক্ষকও কখনও প্রাক্তন হন না। আমি স্যারকে সমর্থন করি।] এসে জড়ো হলেন লেকচার থিয়েটারে! সবার চোখে-মুখে আনন্দের ছাপ! তাঁদের সবার আনন্দ এই জন্য যে, তাঁদের প্রিয় শিক্ষক সফলভাবে কর্মজীবন শেষ করে জীবনের আরেকটি অধ্যায় (একান্ত নিজের জন্য) শুরু করতে যাচ্ছেন! আকিহিরো নোসে সেন্সেও চক-চকে ঝক-ঝকে হাসি নিয়ে পুরোটা লেকচার শেষ করলেন। তাঁর ছাত্রছাত্রীর তালিকায় একদম শেষে আমার নামটি মুদ্রিত দেখতে পেয়ে আমিও চক-চকে ঝক-ঝকে হাসিতে আকুল হলাম। কান্না বিহীন রিটায়ারমেন্ট অনুষ্ঠান দেখে আমি অবাকও হলাম। জাপানিজ মানুষদের গুরুত্বপূর্ণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হলো এই “মুজো (むじょう) [ক্ষণকালীনতা]” মেনে নিয়ে আনন্দচিত্তে পথচলা।
আমরা যেখানে যাই সেখানেই শেকড় গেড়ে বসে পড়ি। সেখানকার সব রস শুষে খেয়ে নিঃশেষ করে দিয়ে আসি। খুব কম ক্ষেত্রেই অবদানে সমৃদ্ধ করে রেখে আসি [ব্যতিক্রমও আছে]। বিদায় নিয়ে আসার সময় কেঁদে-কেটে একাকার করে দিই; আর বাড়ি পৌঁছানোর আগেই আবার সব ভুলে যাই! জাপানিজরা এরকমটা নয়। তাই তারা ঝরে পড়া চেরি ফুল (সাকুরা) দেখে আনন্দিত হয়, ঋতুর চলে যাওয়া দেখেও আনন্দিত হয়, ঋতুর আগমনও আনন্দচিত্তে গ্রহণ করে নেয়। জাপানিজরা ‘জন্ম-মৃত্যু-পূণর্জন্ম’-র এই চক্রের প্রতিটা পর্বকেই স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়। The appreciation of the beauty in non-eternity and transience is a uniquely Japanese value.
আমার আরেকজন সুপারভাইজার তেই শোকি সেন্সের গল্প অন্যদিন বলবো…
বাকি রইলো ১৪ টি। সাথে থাকুন