ক্যাবের সংবাদ সম্মেলন: কৃষকের পণ্য ৩০ টাকা, কিন্তু ভোক্তা কিনছে ‘১০০ টাকায়’
কৃষকরা ৩০ টাকায় পণ্য বিক্রি করলেও ভোক্তা সেটি ৮০-১০০ টাকায় কিনতে বাধ্য হন বলে জানিয়েছেন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। তিনি বলেছেন, এর মূল কারণ হলো–বিপণন ব্যবস্থার জটিলতা ও মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট। সার ও বীজের খরচের কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ক্যাব সমবায়ভিত্তিক আধুনিক বাজার গড়ে তোলার উদ্যোগ নিচ্ছে। নতুন পাইকারি হাব চালু হলে ভোক্তা ২০ টাকার মতো সাশ্রয় পাবেন।
শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) শফিকুল কবির মিলনায়তনে আয়োজিত ‘ক্যাবের কার্যক্রম অবহিতকরণ বিষয়ক’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এসব কথা বলেন ক্যাব সভাপতি।
সফিকুজ্জামান বলেন, দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে সমস্যা দুটো। মূলত উৎপাদন খরচ এবং বিপণন ব্যবস্থা। আমরা বেশিরভাগ কৃষিপণ্য দেশে উৎপাদন করি, কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সেই উৎপাদনের খরচ কি যৌক্তিক? কৃষকদের জন্য সরকার বিভিন্নভাবে সহায়তা ও সাপোর্ট দেয়। যেমন কৃষি ঋণ, ভর্তুকি ইত্যাদি। তবু বাস্তবে সেই সহায়তা কৃষকের কাছে কতটা পৌঁছে, সেটা অনুসন্ধানযোগ্য প্রশ্ন।
চলতি বছরের কৃষি তহবিল প্রায় ৩০০ কোটি টাকার মতো জানিয়ে ক্যাব সবাপতি বলেন, আমি এই বিষয়টি গোয়েন্দা তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখব, কৃষি ঋণ সত্যিই সরাসরি কৃষকের কাছে পৌঁছাচ্ছে কি-না। মধ্যস্বত্তভোগীরা কৃষকের স্বাক্ষর ব্যবহার করে ঋণ নিয়ে নিচ্ছে কি-না ইত্যাদি।
সফিকুজ্জামান বলেন, আমার মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকরা ঋণ বা সাপোর্ট সরাসরি পাচ্ছেন না। অনেক সময় তাদের স্বাক্ষর নিয়ে একটি সিন্ডিকেট কোনো গোষ্ঠীকে অর্থানুষ্ঠানিক সুবিধা দেয়। কৃষক শেষ পর্যন্ত উচ্চ সুদে পুঁজি নেন বা তাদের পণ্য নিম্ন মূল্যে বিক্রি করতে বাধ্য হন। ফলস্বরূপ একটি পণ্যের বাস্তব উৎপাদনখরচ তুলণামূলকভাবে কম থাকলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে মূল্যে বাড়তি চাপ পড়ে এবং ভোক্তা দরও বেড়ে যায়।
সার ও বীজ নিয়ে তিনি বলেন, ফার্টিলাইজার ও বীজের খরচ নিয়েও সমস্যা আছে। সরকার ওইগুলোতে সাবসিডি (ভর্তুকি) দিয়ে সরবরাহ করলেও ডিলার-ডিস্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে কমিশন ও অতিরিক্ত খরচ যোগ হলে কৃষকের হাতে তা ঠিকঠাক পৌঁছায় না। ডিলারশিপের কারণে উচ্চ মূল্যে বিক্রি হলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, এর প্রভাব লক্ষণীয়। পাশের দেশের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের অনেক ক্ষেত্রেই উৎপাদন খরচ বেশি হচ্ছে; ফলে প্রতিযোগিতায় আমাদের পণ্য দুর্বল হয়ে পড়ে।
জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সাবেক এই মহাপরিচালক বলেন, সবচেয়ে বড় সমস্যা হল বিপণন ব্যবস্থা। বাংলাদেশের বর্তমান বিপণন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে আধুনিক নয়। পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের জটিল মাধ্যম, অপ্রতিষ্ঠিত মধ্যস্বত্তভোগীদের কারণে কৃষকের পণ্য থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত দাম অনেক বেড়ে যায়। উদাহরণস্বরূপ, যদি কৃষককের ৩০ টাকা দামের পণ্য সরাসরি পাওয়া যেত, তবে খুচরা পর্যায়ে একই পণ্য ৮০–১০০ টাকায় না গিয়ে যথেষ্ট সস্তা থাকতে পার। কিন্তু মধ্যবর্তী চ্যানেলগুলোতে অতিরিক্ত ৪০-৭০ টাকা চলে যায়, যা ভোক্তা ও কৃষক দুজনকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সফিকুজ্জামান আরও বলেন, আমরা বিপণন ব্যবস্থাকে মডার্নাইজ করে সমবায়ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ার চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে আমি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি এবং খুব শিগগিরই একটি নতুন হাব/বাজারের উদ্বোধন ঘোষণা করব। এটি একটি হাব (হোলসেল) মার্কেট, যেখানে ট্রাক থেকে নামানোর পর কৃষক সরাসরি পণ্য আনতে পারবে এবং তা দ্রুত বাজারে পৌঁছাবে। এতে করে খুচরা পর্যায়ে কমপক্ষে ২০ টাকার মতো সাশ্রয় সম্ভব হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
ক্যাব সভাপতি বলেন, আমাদের বিপণন ব্যবস্থার বদল এবং মধ্যস্বত্তভোগী সিন্ডিকেট ভাঙা না গেলেই উৎপাদনখরচ ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। এই কাজের জন্য আমি মাঠপর্যায়ের তদন্ত, সরকারি তদারকি, সমবায় নির্ভর উদ্যোগ ও সরাসরি বাজার হাব প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছি। এগুলো বাস্তবায়িত হলে কৃষক-ভোক্তা দুই পক্ষই উপকৃত হবে এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়তা মিলবে।
তিনি বলেন, ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব বেশি জানেন না, এটি মেনে নিতে হবে। আমি মনে করি আপনি কিছুটা জানেন, আমরাও জানি; তবু তা ১৮ কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তর কাজ করছে, আমরা ক্যাব ও আমাদের সোশ্যাল মিডিয়া ও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে এটি জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। প্রথম পর্যায়ে আমরা নভেম্বরের ১৫ তারিখের মধ্যে আটটি বিভাগে প্রোগ্রাম আয়োজন করছি; এরপর ধাপে ধাপে আরও প্রান্তিক পর্যায়ে যাব। কেন্দ্রীয়ভাবে সবকিছু করা সম্ভব নয়। অতএব আমাদের বিভাগীয় কমিটিগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। যাতে তারা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কাজ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারে।
ক্যাব সভাপতি এ এইচ এম সফিকুজ্জামান লেন, আমাদের কাজের বড় বাধা লজিস্টিক ও আর্থিক সংকট। আমাদের সম্পদ সীমিত, তাই আমরা ইতিমধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান ও অংশীদারের সঙ্গে যৌথ এজেন্ডা গ্রহণ করেছি যাতে জনগণকে সচেতন করে তোলা সহজ হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া, কোষাধ্যক্ষ ড. মো. মুঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার, প্রচার সম্পাদক মো. মুসা মিয়া ও নির্বাহী কমিটিরি সদস্য মোহা. শওকত আলী খান।