কিসিঞ্জারের চীন সফর যে বার্তা দিচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী শতবর্ষী হেনরি এ কিসিঞ্জারকে বেইজিংয়ে লালগালিচা স্বাগত জানান চীনের শীর্ষ নেতা শি জিনপিং। কিসিঞ্জারকে তিনি বলেন, ‘চীনের মানুষ আপনাকে সর্বদা মনে রাখবে।’ কিসিঞ্জারের জন্য চীনের উৎসাহী অভ্যর্থনা বেইজিং কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে তার বার্তা পৌঁছাতে পারে, এর সর্বশেষ উদাহরণ হয়ে রইল। ওয়াশিংটনের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করার জন্য সরকারি কূটনৈতিক চ্যানেলের বাইরেও চেষ্টা করতে চীন যে দ্বিধাহীন– তাও এ ঘটনায় প্রমাণ হলো। তবে বেইজিংয়ের এই চেষ্টার কারণ, চীন বাইডেন প্রশাসনের কথাবার্তায় ঠিক ভরসা রাখতে পারছে না; তাদের প্রতি আরও সংশয়বাদী হয়ে উঠছে। এ কারণেই বেইজিং মাঝেমধ্যে বাইডেন প্রশাসন সম্পর্কে প্রকাশ্যে হতাশা ব্যক্ত করছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের এই সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং অন্য কর্মকর্তারা তাঁকে ‘পুরোনো বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা দেখাতে চান, বেইজিং বিশ্বের ক্ষমতাধরদের মধ্যে সহযোগিতা এবং পারস্পরিক মর্যাদার বিষয়টি গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আগে চীন সফর করেন মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস। তাঁকেও শি জিনপিংয়ের পুরোনো বন্ধু বলে ডাকা হয়। তার আগে চীন সফর করেন টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক। বস্তুত প্রতিটি সফরেই চীন দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকটের কারণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করেছে। এ ধরনের প্রচেষ্টা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। চীনকে ভূ-রাজনৈতিক, সামরিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে পিছিয়ে রাখতে বাইডেন প্রশাসনের চেষ্টার বিরুদ্ধে বেইজিং উদ্যোগ নিচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান এবং ডেমোক্র্যাটরা বেইজিংয়ের ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকতে চায়। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এগিয়ে আসছে, সেখানে যেসব প্রার্থী চীনের বেশি সমালোচনা করবে, তারা হয়তো বেশি জনপ্রিয় হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি-সিআইএর চীন বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ডেনিস ওয়াইল্ডার বলেছেন, মনে হচ্ছে, এটি চীনের পরিকল্পিত কৌশল, যাতে তাদের বিষয়ে ওয়াশিংটনের মতের পরিবর্তন হয়। সে লক্ষ্যে চীন এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করছে, যাদের চীনা অর্থনীতি এবং সামগ্রিক সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। আমরা দেখেছি, বেশ কয়েক মাস চুপ থাকার পর দুই দেশ বাণিজ্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে পুনরায় যুক্ত হতে শুরু করেছে। তবে অগ্রগতি খুব সামান্যই ঘটেছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জলবায়ু দূত জন কেরি এই সপ্তাহে চীনে কোনো নতুন চুক্তি ছাড়াই আলোচনা থেকে বেরিয়ে এসেছেন। কারণ বেইজিং যুক্তি দিয়েছিল, দুই দেশের সম্পর্কের টানাপোড়েনই ওয়াশিংটনের সঙ্গে বিশ্ব উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চীনের সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত করছে।
দু’পক্ষের বৈঠক হলেও নানা প্রসঙ্গ এসে উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। চীন চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রযুক্তির ওপর থেকে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করুক; তাইওয়ানের প্রতি তার সমর্থন উঠিয়ে নিক এবং এশিয়াজুড়ে মার্কিন মিত্র ও অংশীদারদের সে ধরনের সম্পর্কে না জড়াক, যেটা বেইজিং মনে করে তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করবে। জো বাইডেন প্রশাসন কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও সেমিকন্ডাক্টরগুলোর সঙ্গে যুক্ত চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমেরিকান বিনিয়োগের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করলে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে পারে। নানজিং ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক ঝু ফেং বলেন, হেনরি কিসিঞ্জারের সফরের সময় ‘চীনকে কৌশলগতভাবে দমন করা থেকে বিরত রাখতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাতদের কীভাবে প্রভাবিত করা যায়, সে সম্পর্কে বেইজিং তার উদ্বেগ প্রকাশ করবে।’ কিসিঞ্জারের পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ হবে। কারণ তাঁর মতো কণ্ঠস্বর ওয়াশিংটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বেইজিং সেই সময়ের কথা স্মরণ করে, যখন হেনরি কিসিঞ্জার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সে সময়টি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে সোনালি যুগ ছিল। যার উদাহরণ, কিসিঞ্জার ১৯৭২ সালে চীনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের ঐতিহাসিক সফরের পথ প্রশস্ত করতে সহায়তা করেছিলেন। সেই সফর সাত বছর পর ওয়াশিংটন ও কমিউনিস্ট শাসিত চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের দিকে নিয়ে যায়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যখন দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ত হয়েছে তখন চীনা কর্মকর্তারা বলেছেন, মার্কিন কর্মকর্তাদের হেনরি কিসিঞ্জার ও তাঁর কর্মতৎপরতা থেকে শিক্ষা নেওয়া উচিত। সেই বিন্দুর দিকে সম্পর্ক আবার চালিত করার জন্য চীনে বৃহস্পতিবার হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে শি জিনপিংয়ের বৈঠকের স্থানটিও ঐতিহাসিক গুরুত্ব তুলে ধরে। চীনা কর্মকর্তারা দিয়াওইউতাই স্টেট গেস্ট হাউসের পাঁচ নম্বর ভিলা বেছে নিয়েছিলেন। এটি সেই স্থান, যেখানে অর্ধশতাব্দী আগে হেনরি কিসিঞ্জার তৎকালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সিসিটিভিতে প্রকাশিত এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন, ‘চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সঙ্গে কিসিঞ্জার নামটি সর্বদা যুক্ত থাকবে।’ সে সময় তারা উভয়েই ক্রিম রঙের আর্মচেয়ারে পাশাপাশি বসেছিলেন। শি আরও বলেছেন, ‘আমি আপনার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করছি।’ চীনের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমে বৈঠকটির আনুষ্ঠানিক সারসংক্ষেপ প্রকাশ হয়, যেখানে শি জিনপিং বলেছেন: আমি আশা করি, আপনি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিরা চীন-মার্কিন সম্পর্ককে সঠিক পথে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতে, চীনের শীর্ষ পররাষ্ট্রবিষয়ক কর্মকর্তা ওয়াং ই হেনরি কিসিঞ্জারের সফরের এক দিন আগে বলেছিলেন, আজ আমেরিকার ‘কিসিঞ্জারের মতো কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং নিক্সনের মতো রাজনৈতিক সাহসিকতা’ প্রয়োজন।
আমেরিকার ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখছে চীন। আগেই বলা হয়েছে, বিল গেটস ও ইলন মাস্ক ছাড়াও অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী টিম কুক এবং জেপি মর্গান চেজের প্রধান নির্বাহী জেমি ডিমন এই বছর চীন সফর করেছেন। তারা কিছু চীনা কর্মকর্তার সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসায়িক নেতাদের এসব সফর চীনের জন্য অর্থনীতিতে বিদেশি আস্থা অর্জনের একটি সুযোগ, যা চীনের অর্থনৈতিক সংকট পুনরুদ্ধারে সহায়তা করবে। মার্চ মাসে বেইজিং ভ্রমণের সময় টিম কুক অ্যাপল স্টোরে তাঁর গ্রাহকদের সঙ্গে সেলফি তুলেছিলেন এবং একটি সরকারি উন্নয়ন ফোরামের বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন। এর মাধ্যমে চীন তিন বছরের কঠোর করোনাভাইরাসের বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে আসে। এর দুই মাস পর ইলন মাস্ক চীন সফর করে দেশটির জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংহাইয়ের শীর্ষ নেতা পর্যন্ত অনেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
চীনা সংবাদমাধ্যমের খবর অনুসারে, টেসলা ও টুইটারের প্রধান ইলন মাস্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার বাণিজ্যের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ট্যাবলয়েড পত্রিকা গ্লোবাল টাইমস লিখেছে, পশ্চিমা কিছু রাজনীতিবিদের কণ্ঠে বিভাজনের আওয়াজ সত্ত্বেও ইলন মাস্কের চীন সফর চীনের বাজারে মার্কিন ব্যবসায়িকদের দৃঢ় আস্থার প্রমাণ। যদিও হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র মিলার কিসিঞ্জারের সফরকে নিতান্তই ব্যক্তিগত সফর বলে আখ্যায়িত করেছেন; যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন এফ কিরবি বলেছেন, বাইডেন প্রশাসন হেনরি কিসিঞ্জারের সফর বিষয়ে আগে থেকেই অবগত। কিন্তু তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন– ‘এটি দুর্ভাগ্যজনক যে, একজন নাগরিক প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে পারে এবং যোগাযোগ করতে পারে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা পারে না।’ কিরবি বৃহস্পতিবার বলেছিলেন, ‘এটি এমন কিছু যা আমরা সমাধান করতে চাই।’ কিরবি এও বলেছেন, প্রশাসন হেনরি কিসিঞ্জারের কাছ থেকে তাঁর সফর সম্পর্কে শোনার জন্য উন্মুখ। তিনি বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ পুনরায় চালু করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
ওয়াশিংটনে স্টিমসন সেন্টারের চীনা কর্মসূচির প্রধান ইউন সান বলেছেন, (গেটস, মাস্ক কিংবা হেনরি কিসিঞ্জার) এই বৈঠকগুলোর মাধ্যমে শি জিনপিং দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্কের গুরুত্ব তুলে ধরার চেষ্টা করছেন বলে মনে হচ্ছে। এটি ইঙ্গিত দিচ্ছে, সম্পর্কে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক হারাতে ভূমিকা রাখতে পারে। চীনের কর্মকর্তারা বিশেষ করে আমেরিকার পরামর্শক সংস্থা বেইন অ্যান্ড কোম্পানির কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করার পর বেইজিংয়ের জন্য এই বার্তাটি আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে এবং অনেক বিদেশি ব্যবসায়ী ভীত হয়ে পড়ছেন।
সান তাঁর বক্তব্যে আরও বলেন, অবশ্য ‘চীন সামগ্রিকভাবে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ধরে রাখতে চায় এবং তারা বড় বড় উচ্চ প্রযুক্তির কোম্পানিকে চীনা বাজারে আকর্ষণের চেষ্টা করছে এবং সেই সক্ষমতা তারা দেখাতে পেরেছে।’ সানের বক্তব্য অনুসারে, ‘চীনারা বিশ্বাস করে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী এই ব্যবসায়ী নেতারা রাজনৈতিক অবস্থানের বাইরে কাজ করার আরও স্বাধীনতা উপভোগ করেন।’ তাঁর মতে, ‘কিন্তু এর আরেকটি বিষয় হলো, চীন তার দেশের সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়টি গুরুত্ব দেয় এবং দেশটি দেখাতে চায়, এ ক্ষেত্রে বেইজিংয়ের নিয়ম অনুসরণ করা হলে তা বিফলে যাবে না।’
নিউইয়র্ক টাইমস থেকে ডেভিড পিয়ারসন, ভিভিয়ান ওয়াং ও এডওয়ার্ড উং এর লেখা অনুবাদ করেছেন মাহফুজুর রহমান মানিক