ওয়াকফ আইন ঘিরে উত্তপ্ত পশ্চিমবঙ্গ
ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর স্বাক্ষরের পর সংসদে পাশ হওয়া ওয়াকফ সংশোধনী বিল আইনে পরিণত হয়েছে। আইনটি বাতিলের দাবিতে বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ চলছে। পথে নেমেছেন মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ। পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে চলছে এই আন্দোলন। কোথাও কোথাও তা সহিংস আকার ধারণ করেছে।
গত তিনদিন ধরে অশান্ত রয়েছে মুর্শিদাবাদের সামশেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ান-সহ বিভিন্ন এলাকা। সামশেরগঞ্জে বাবা-ছেলেকে পিটিয়ে, কুপিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছে। রানিপুরের জাফরাবাদে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
গুলিবিদ্ধ হয়ে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছে সুতিতে। সাজুর মোড়ে অবরোধ চলছিল। সেই সময়ে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ শুরু হয়। এই ঘটনার মধ্যে পড়ে গুলিবিদ্ধ হয় সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ইজাজ আহমেদ। পরে হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। আরো একজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আহত সামশের নাদাব এখন হাসপাতালে ভর্তি।
রাজ্য পুলিশের এডিজি (আইনশৃঙ্খলা) জাভেদ শামিম বলেন, সাজুর মোড়ে সংযত থেকে পুলিশ পদক্ষেপ করেছিল। কিন্তু উত্তেজিত জনতাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। প্রায় তিন ঘণ্টা পুলিশের উপরে হামলা চলে, দোকানপাট ভাঙচুর করা হয়। বাধ্য হয়ে পুলিশকে চার রাউন্ড গুলি চালাতে হয়। জঙ্গিপুরের তৃণমূল সাংসদ খলিলুর রহমানকেও ছাড় দেয়নি জনতা। তিনিও বিক্ষোভস্থলে হেনস্থার মুখে পড়েন।
মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী
পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় কলকাতা হাইকোর্ট মুর্শিদাবাদে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের নির্দেশ দেয় শনিবারই। এই আবেদন জানিয়ে আদালতের দ্বারস্থ হন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তার আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে বিচারপতি সৌমেনে সেন ও বিচারপতি রাজা বসু চৌধুরীর স্পেশাল বেঞ্চ শনিবার বলে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কেন্দ্রীয় বাহিনী ও স্থানীয় পুলিশ-প্রশাসন একজোট হয়ে কাজ করবে ।
মুর্শিদাবাদে অশান্তি বাড়ার পরে পুলিশের তৎপরতাও বেড়েছে। রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার শনিবার সন্ধেয় জেলায় পৌঁছান । সেখানে তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জীবন রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব। তাই যেখানে যতটুকু প্রয়োজন পুলিশ পদক্ষেপ করেছে। কিন্তু পুলিশের সংযমকে দুর্বলতা হিসাবে দেখবেন না। প্রয়োজনে কঠোরতম পদক্ষেপ করবে পুলিশ।’’
শনিবার রাত থেকে জেলার কিছু অংশে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। রাতভর এই বাহিনী সুতি, সামশেরগঞ্জ থানা এলাকায় টহল দিয়েছে। পুলিশের সঙ্গে যৌথ দল গ্রামে গ্রামে গিয়েছে। তল্লাশি অভিযানে ব্যাপক ধরপাকড় চলছে। মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৩৮ জনে। নতুন করে অশান্তি এড়াতে রবিবার সকালে যৌথ রুটমার্চ করা হয়েছে ।
বিএসএফ আগেই ময়দানে নেমেছে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে। জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র বলেন, ‘‘বিএসএফকে ডাকা হয়নি। যেহেতু এই এলাকাটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী, তাই বিএসএফ এই এলাকায় এসেছে।’’
রবিবারও বিভিন্ন এলাকা ছিল থমথমে। ১৭ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। তবু আতঙ্কে জেলার বাসিন্দাদের একাংশ ঘর ছাড়ছেন। মুর্শিদাবাদের গঙ্গার বিপরীত দিকে মালদার বৈষ্ণবনগর। সেখানে দলে দলে মানুষ চলে যাচ্ছেন নদী পেরিয়ে। কেউ কেউ চলে যাচ্ছেন পাশের রাজ্য ঝাড়খণ্ডে।
সহিংসতায় ব্যক্তিগত ও সরকারি সম্পত্তির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উত্তেজিত জনতা রেল স্টেশনেও ভাঙচুর চালিয়েছে । আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় স্টেশন লাগোয়া রেলের অফিসে । এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবকে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা । একের পর এক জায়গায় বোমাবাজি, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায় এনআইএ তদন্তের আর্জি জানিয়েছেন তিনি । তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, এর পেছনে বিজেপির ষড়যন্ত্র আছে কি না, সেটা দেখতে হবে। অন্য রাজ্যের অশান্তির ছবি পশ্চিমবঙ্গের বলে পোস্ট করা হচ্ছে।
শান্তি বজায় রাখার আবেদন জানিয়ে বার্তা দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এক্স পোস্টে লিখেছেন, ‘কিছু রাজনৈতিক দল ধর্মকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে চাইছে। তাদের প্ররোচনায় পা দেবেন না। আমি মনে করি, ধর্ম মানে মানবিকতা, সহৃদয়তা, সভ্যতা ও সম্প্রীতি। সকলে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখুন— এই আমার আবেদন।’
ভিডিও বার্তায় রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বলেছেন, ‘‘গণতন্ত্রে প্রতিবাদ করা যায়, কিন্তু বিশৃঙ্খলা কাম্য নয়। দুষ্কৃতিদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’
তৃণমূল-বিজেপির সংঘাত?
এদিকে পরিস্থিতি মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনের ব্যর্থতাকে দায়ী করছে বিরোধীরা। সাবেক পুলিশকর্তা নজরুল ইসলামের একই মত। ডিডাব্লিউকে বলেন, পুলিশ শক্ত হাতে পরিস্থিতির মোকাবিলা করলে এই পরিস্থিতি হতো না। বিএসএফকে ডাকতে হতো না। চাকরি বাতিল নিয়ে যখন রাজ্যে উত্তাল, তখন সবার নজর ঘুরে গিয়েছে মুর্শিদাবাদের দিকে। এটা হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা নয়। এটা তৃণমূল-বিজেপির সমস্যা। ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ হলে ওদের সুবিধা। তাই এ ধরনের ঘটনা আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলেন, বহু মানুষ ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করছে। কয়েকটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে আমারও বিরোধিতা রয়েছে। বিরোধিতা থাকা মানে এই নয়, আইন নিজেদের হাতে তুলে নিতে হবে। চার দিন ধরে সহিংসতা চলছে আর সরকার সেটা দেখে যাচ্ছে, এটা চলতে পারে না। যেদিন ১০ হাজার মানুষ হাইওয়ে অবরোধ করল, সেদিন কঠোর হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে, আজ এতটা সহিংসতা হতো না। এটা শুধু বিরোধীরা বলছে না, তৃণমূলের ভিতর থেকে একথা শোনা যাচ্ছে যে, পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছে। গোড়াতেই বিষয়টা সামলে নিলে তিনটে প্রাণ চলে যেত না।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক সহিংসতা ঘটে থাকে অহরহ। ধর্মীয় কারণে ব্যাপক অশান্তি খুব একটা দেখা যায় না। রাজনৈতিক বিশ্লেষক মইদুল ইসলাম বলেন, পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুরা নিজে থেকে এমন সহিংসতা করছে, এই উদাহরণ স্বাধীনতা পরবর্তী কয়েক দশকে নেই। এটা একটা নতুন প্রবণতা। সাম্প্রতিক অতীতে অবশ্য দেগঙ্গা, মালদা, ধূলাগড় এলাকায় বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে। মুর্শিদাবাদে যেখানে গণ্ডগোল হচ্ছে, সেখানে কোনো শক্তিশালী মুসলিম নেতৃত্ব নেই যারা জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। এতে সংখ্যাগুরুর ভোট সংহত হবে, যার ফলে সুবিধা হবে বিজেপির। সব সংখ্যালঘুর ভোট তৃণমূল পাবে না। বাম ও কংগ্রেস কিছু ভোট পাবে। উল্টোদিকে যদি ভোট সংহত হয়, তাহলে বিজেপি উপকৃত হবে। তবে নয়া আইন অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ড যেভাবে গঠিত হবে, সেক্ষেত্রে অমুসলিমদের গুরুত্ব বেড়ে যেতে পারে, যাদের ওয়াকফ সম্পত্তির সঙ্গে কোনো যোগ নেই। এটা সংখ্যালঘু মানুষকে বিচলিত করেছে।
সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, মুর্শিদাবাদে সিএএ বিরোধী আন্দোলনের সময় ট্রেনে আগুন ধরানো হয়েছিল। এই দায় মুসলিমদের ঘাড়ে চাপানোর কোনো মানে নেই। আমার ধারণা, এ কাজ পরিকল্পিতভাবে কোনো সংগঠন করছে। যেভাবে ঘটনা ঘটছে, তার কতটা সুপরিকল্পিত, আর কতটা প্রতিবাদ, সেটার তদন্ত হওয়া উচিত।
ওয়াকফ বোর্ডের আওতাধীন জমিতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মসজিদ, মাদ্রাসা, কবরস্থান, এতিমখানা রয়েছে। কেন্দ্রীয় রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে এমন সম্পত্তির সংখ্যা আট দশমিক সাত লক্ষ। উত্তরপ্রদেশ সুন্নি ও শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের হাতে সম্পত্তির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সংখ্যালঘু মন্ত্রকের গত মাসের হিসেব অনুযায়ী, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে এ রাজ্য। পশ্চিমবঙ্গে মোট ৮০ হাজার ৪৮০টি ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তি রয়েছে ৮২ হাজার একরের বেশি জমির উপরে। ওয়াকফ সম্পত্তি ‘জবরদখলের’ অভিযোগ উঠেছে একাধিক তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে। যদিও তা অস্বীকার করেছেন তারা।