এত অভিযোগের পরও কেন হাসিনার ভাগ্নি টিউলিপকে মন্ত্রী করেন স্টারমার?
যুক্তরাজ্যে প্রশিক্ষিত ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলে ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের একজন। এক রাতে সশস্ত্র ব্যক্তিরা তাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল।
আট বছর বিনা বিচারে আটকে রাখা হয়েছিল মীর আহমেদ বিন কাসেমকে। তখন তার হাত ও চোখ থাকত বাঁধা। ওই সময়ে কোথায় ছিলেন, কেন তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখা হয়েছিল, কিছুই তিনি জানেন না।
হাসিনা সরকারের পতনের পর আহমেদ বিন কাসেমকে একটি গাড়িতে উঠিয়ে খাদে ফেলে দেওয়া হয়। শেষে তিনি বাড়িতে ফিরতে পারেন। গত বছরের আগস্টে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। টানা কয়েক মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
একাত্তরের পর হাসিনার আমলেই সবচেয়ে বেশি সহিংসতা দেখেছে বাংলাদেশ। এতে শত শত মানুষ নিহত হন। তার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার শেষ দিনেও অন্তত ৯০ জন নিহত হন।
হাসিনা যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির আইনপ্রণেতা (এমপি) টিউলিপ সিদ্দিকের খালা। দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ মাথায় নিয়ে কয়েকদিন আগেই প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক মন্ত্রীর পদ থেকে সরে যান টিউলিপ।
টিউলিপ সবসময়ই তার এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। অভিযোগগুলোর একটি হলো বাংলাদেশের অবকাঠামো নির্মাণের ব্যয় থেকে ৩ দশমিক ৯ বিলিয়ন (৩৯০ কোটি) পাউন্ড পর্যন্ত আত্মসাৎ করেছে তার পরিবার।
এ ছাড়া লন্ডনে টিউলিপের বিরুদ্ধে তার খালা হাসিনার রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠদের সম্পত্তি ব্যবহারের অভিযোগও রয়েছে। স্টারমার সরকারের তদন্তে মন্ত্রিত্বের আচরণগত নীতিমালা টিউলিপ ভাঙেননি, এমনটি বলা হচ্ছে। তবে তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
এই ঘটনা স্টারমারের বিচক্ষণতা এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মানুষের ভোট আকর্ষণে লেবার পার্টির দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্বেগজনক নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
এসব প্রশ্নের একটি হলো, নানা কেলেঙ্কারিতে জড়ানো খালা হাসিনার সঙ্গে টিউলিপের যে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, সে বিষয়ে অনেক আগে থেকে জানার পরও লেবার পার্টি এখনকার ঘটনা আঁচ করতে পারল না কেন।
আর আহমেদ বিন কাসেমের গুমের ঘটনা তো ২০১৬ সালেই প্রকাশ পেয়েছিল। তখন তো বাংলাদেশে শেখ হাসিনার শাসনামলই চলছিল। টিউলিপের বিষয়ে আরও আগেই লেবার পার্টির কারো উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত ছিল।
আহমেদ বিন কাসেমসহ অন্য বাংলাদেশিদের ‘গুম’ হওয়ার ঘটনা এবং মানবাধিকার নিয়ে তখন থেকে টিউলিপের প্রকাশ্য অবস্থান এক অসামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবনারও জন্ম দিয়েছে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিজ নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা নাজানিন জাঘারি–র্যাটক্লিফকে ইরান থেকে মুক্ত করার জন্য দীর্ঘ প্রচার চালান টিউলিপ।
অথচ বাংলাদেশে তার খালার শাসনামলে লোকজনের দুঃখ–দুর্দশা এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে জনসমক্ষে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে টিউলিপের নির্লিপ্ততা ছিল উল্লেখ করার মতো।
রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে হাসিনার বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন টিউলিপ। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র হয়ে বিবিসি টেলিভিশনেও হাজির হয়েছিলেন তিনি।
২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে এমপি নির্বাচিত হন টিউলিপ। তখন সহায়তার জন্য আওয়ামী লীগের সদস্যদের ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন তিনি। দলটির সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে ২০০৮ ও ২০০৯ সালে তার ওয়েবসাইটে দুই পৃষ্ঠার বর্ণনা থাকলেও পরে তা মুছে ফেলা হয়।
তবে একপর্যায়ে পার্লামেন্টে টিউলিপ সাংবাদিকদের বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব খাটানোর কোনো সক্ষমতা বা আকাঙ্ক্ষা তার নেই।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে টিউলিপের সংশ্লিষ্টতা গোপন ছিল না। তবে সম্ভবত লেবার পার্টি তার এ সংশ্লিষ্টতাকে বাজেভাবে দেখেনি। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে দলটির দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টি তেমন দেখা যায়নি।
২০১২ সালে লেবার পার্টির তৎকালীন এমপি জিম ফিজপ্যাট্রিক কমন্স সভায় বলেছিলেন, তারা ‘সহযোগী সংগঠন’। একই রকম ধারণা পোষণ করতেন তার অনেক সহকর্মীও।
২০১৫ সালে স্টারমারও টিউলিপের পাশের আসন থেকে নির্বাচিত হয়ে পার্লামেন্টে যান। একাধিকবার হাসিনার সঙ্গে দেখাও করেন তিনি। হাসিনার সঙ্গে স্টারমারের এমন এক সাক্ষাৎ হয়েছিল ২০২২ সালে।
তবে স্টারমারের এক সহযোগীর যুক্তি ছিল, বৈঠকটি হাসিনার নীতির প্রতি তার সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ছিল না।
বছরের পর বছর বাংলাদেশকে পাশে রাখার লেবার পার্টির দৃশ্যমান প্রচেষ্টা হয়তো যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে, বিশেষ করে রাজধানী লন্ডনের কিছু অংশে।
লেবার পার্টির বিশিষ্ট এক নেতার ব্যাখ্যা হলো, বাংলাদেশি ভোট না বুঝে পূর্ব লন্ডনে আপনি সফল হতে পারবেন না।
অবশ্য তিনি বলেন, আপনার কথা ও কাজের মধ্যে সতর্কভাবে ভারসাম্য বজায় রাখা উচিত। আপনি যদি একটি দলের (বাংলাদেশি) বিষয়ে অতিরিক্ত খোলামেলা মনোভাব দেখান, তবে আপনার সমালোচনা তো হবেই।
ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের অন্তত ১৭টি আসনে বাংলাদেশি ভোটারের সংখ্যা লেবার পার্টির জয়ের ব্যবধানের চেয়েও বেশি।
স্টারমারের হলবর্ন ও সেন্ট প্যানক্রাস আসনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সংখ্যা অন্তত ছয় হাজার।
গত জুলাইয়ে নির্বাচনে জেতার পরপরই স্টারমার যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিতে টিউলিপকে নিয়োগ দেন। তখন আওয়ামী লীগের প্রতি লেবার পার্টির সহানুভূতি ও লন্ডনের রাজনৈতিক বাস্তবতাই কি দুর্নীতি নিয়ে সম্ভাব্য ঝড়ের ব্যাপারে স্টারমারের বিচারবোধ ম্লান করে দিয়েছিল?
লেবার পার্টির একটি সূত্র বলেছে, ‘নিজের বন্ধুবান্ধব ও রাজনৈতিক সহকর্মীদের প্রতি স্টারমারের অন্ধভক্তি রয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। ’
অনুসন্ধানী সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান বলেন, অনেক বছর আগেই টিউলিপের বিষয়ে লেবার পার্টির কারো না কারো উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত ছিল। টিউলিপকে নিয়ে প্রথম অনাবিষ্কৃত উদ্বেগের ক্ষেত্র ছিল, বাংলাদেশে জোর করে গুমের ঘটনায় তার সাড়া দেওয়ার ব্যর্থতার বিষয়টি। এরপরের ক্ষেত্রটি ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি।
এ বিষয়ে লেবার পার্টির এমপিদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, ব্রিটিশ গণমাধ্যমের পাশাপাশি লেবার পার্টির মধ্যে বাংলাদেশ নিয়ে জানাশোনার ঘাটতি আছে।
টিউলিপ লেবার পার্টির এমপি থাকতে পারবেন কি না, আগামী কয়েক মাসে সেটিও স্টারমারের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের জন্য সম্ভাব্য আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠতে পারে।