একেবারেই বাড়ি ফিরছেন হাদিসুর, গ্রামেই হবে শেষ শয্যা
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
অসীম সমুদ্রে রোমাঞ্চকর যাত্রার সুযোগ ছিল হাদিসুর রহমানের, জাহাজে চড়ে ঘুরতেন বন্দরে বন্দরে, তবু মনের নোঙ্গরটি পোঁতা ছিল বরগুনার বেতাগীতে, হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামে। ইচ্ছে ছিল শিগগিরই গ্রামে ফিরে হাত দেবেন বাড়ির কাজে; কথা ছিল, আগামী নভেম্বরে বিয়ে করবেন; স্বপ্ন ছিল, বদলে দেবেন পরিবারের জীবন। সেই বাড়িতেই তিনি ফিরছেন কফিনবন্দি হয়ে, চিরঘুমে শায়িত হবেন নিজেরই আঙিনায়।
হাদিসুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের জাহাজ বাংলার সমৃদ্ধির থার্ড ইঞ্জিনিয়ার। ইউক্রেইনে যুদ্ধের মধ্যে মিসাইল হামলার শিকার হয় জাহাজটি। ১২ দিন আগের ওই ঘটনা কেবল তার পরিবার নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্যই একটি বড় ধাক্কা হয়ে এসেছিল।
যুদ্ধের ভয়াবহতা পেরিয়ে জাহাজের বাকি ২৮ নাবিক আর প্রকৌশলী দেশে ফেরেন গত ৯ মার্চ। আর হাদিসুরের কফিন টার্কিশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে সোমবার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ঢাকা পৌঁছায়। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মরদেহ বুঝে নেন হাদিসুরের ছোট ভাই গোলাম মাওলা প্রিন্সসহ পরিবারের কয়েকজন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বরগুনা-২ আসনের এমপি শওকত হাচানুর রহমান রিমনও ছিলেন সেখানে।
ইউক্রেনে রকেট হামলায় মৃত্যু হয় বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের।ইউক্রেইনে রকেট হামলায় মৃত্যু হয় বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হাদিসুর রহমানের।হাদিসুরের লাশ নিয়ে ফ্রিজার ভ্যান যখন বিমানবন্দরের কার্গো ফটক দিয়ে বেরিয়ে আসছিল, স্বজনদের আহাজারি আর মাতমে ভারি হয়ে ওঠে পরিবেশ।
বিলাপ করতে করতে প্রিন্স শুধু বলছিলেন, ভাইগো, ও আমার ভাই, কি হলো রে ভাই, আমি কীভাবে বাঁচব রে ভাই, আমার ভাইরে ফিরায়া দাও। বিমানন্দরের রানওয়েতে মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়ার সময় সামনের ফটকে কাঁদছিলেন হাদিসুর খালা শিরিন আক্তার, চাচাতো ভাই সোহাগ হাওলাদারসহ অন্যরা। শোকাবহ পরিস্থিতির মধ্যে বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা সেরে ঘণ্টাখানেক পর কফিন নিয়ে তারা রওনা হন বরগুনার বেতাগীতে গ্রামের বাড়ির পথে।
বেতাগীর হোসনাবাদ ইউনিয়নের কদমতলা গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত মাদ্রাসা শিক্ষক আবদুর রাজ্জাকের চার ছেলেমেয়ের মধ্যে হাদিসুর ছিলেন মেজ। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে পড়ালেখা শেষ করে ২০১৮ সালে এমভি বাংলার সমৃদ্ধি জাহাজে ওঠেন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে।
জাহাজের চাকরিতে বছরের একটি বড় সময় থাকতে হয় বাইরে। সবশেষ বাড়ি এসেছিলেন মাস ছয়েক আগে। তবে পরিবারের সঙ্গে কথা হত নিয়মিত। যেদিন জাহাজে রকেট পড়ল, সেদিনও ফোনে মা রাশিদা বেগম আর ছোট ভাই তরিকুল ইসলাম তারেকের সঙ্গে তার কথা হয়েছিল।
তার মৃত্যুর খবর আসার পর তারেক বলেছিলেন, দেশে ফিরলেই বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল হাদিসুরের, স্বপ্ন ছিল পরিবারের জন্য আরও অনেক কিছু করার; সেজন্য যত দ্রুত সম্ভব বাড়ি ফিরতে চাইছিলেন তিনি।
হাদিসুরের বাবা আবদুর রাজ্জাক জানান, গত ডিসেম্বরের শুরুতে বাড়ি থেকে শ্রীলঙ্কায় যান হাদিসুর। কলম্বো গিয়ে বাংলার সমৃদ্ধিতে যোগ দেন। এরপর গত ২৬ জানুয়ারি ভারতের মুম্বাই বন্দর থেকে বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজটি ইউরোপের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তুরস্কের একটি বন্দরে পণ্য খালাস করে ২৪ ফেব্রুয়ারি পৌঁছায় ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরে।
ছুটি শেষে আগামী নভেম্বরে দেশে ফিরে হাদিসুরের বিয়ে করার ছিল বলে জানান খালা শিরিন আক্তার। বিমানবন্দরে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমি এখানে কারে বিয়ে করামুরে।
ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবার বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আবদুর রাজ্জাক। হাদিসুরের ছোট দুই ভাইয়ের মধ্যে তরিকুল ইসলাম তারেক পড়েন পটুয়াখালী সরকারি কলেজের রসায়ন বিভাগের শেষ বর্ষে; আর সবার ছোট গোলাম মাওলা প্রিন্স ঢাকার কবি নজরুল কলেজের অর্থনীতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।
অবসরপ্রাপ্ত বাবার একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলের মর্মান্তিক বিদায়ে পরিবারটি সংকটের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন খালা শিরীন আক্তার। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, ওদের সংসার এখন কে দেখবেরে?
স্থানীয় এমপি হাচানুর রহমান রিমন বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সামনে প্রতিশ্রুতি দেন, হাদিসুরের পরিবারের সহায়তায় তিনি কাজ করবেন। ওদের ফ্যামিলির মধ্যে ওই একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিল। ওই ফ্যামিলিটা চালাইত। পুরো বেতাগীবাসী শোকে মুহ্যমান। আমাদের এলাকার সবাই। কারণ ওদের ফ্যামিলির দিকে তাকানো যায় না। আমরাতো আগে চিন্তায় ছিলাম লাশ আসবে কি-না। এটা বড় অর্জন লাশটা এসেছে, আমাদের সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে যুদ্ধের মধ্যে আমরা লাশ নিয়ে আসতে পেরেছি।
এমপি রিমন বলেন, এখন আমরা লাশ দাফন করব। এরপর প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে ওদের ফ্যামিলির জন্য কিছু করা দরকার হলে করব। আমার বিশ্বাস, প্রধানমন্ত্রী তা করবেন।
ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরে আটকে থাকা অবস্থায় ২ মার্চ রকেট হামলায় ‘বাংলার সমৃদ্ধির’ ব্রিজ দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরদিন ৩ মার্চ জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নাবিকদের নামিয়ে আনা হয়। সেখান থেকে একটি শেল্টার হাউজের বাংকারে ঠাঁই নেন তারা। হাদিসুরের মরদেহও রাখা হয়েছিল বাংকারের ফ্রিজারে।
মলদোভা, রোমানিয়া হয়ে গত ৯ মার্চ দেশে ফেরেন ২৮ নাবিক ও প্রকৌশলী। তাদের দেশে ফেরার খবরে ওইদিন বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন হাদিসুরের পরিবারের সদস্যরা। তারা আকুতি জানান দ্রুত তার মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য।
সরকার আর প্রবাসীদের চেষ্টায় শুক্রবার ভোরে ইউক্রেন থেকে রওনা হয়ে হাদিসুরের লাশবাহী গাড়ি রাতে প্রতিবেশী দেশ রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্টে পৌঁছায়। সেখান থেকে টার্কিশ এয়ারওয়েজের একটি কার্গো ফ্লাইটে তার কফিন পাঠানো হলেও বিরূপ আবহাওয়ায় তা পৌঁছাল এক দিন দেরিতে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কনস্যুলার অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার উইংয়ের পরিচালক মনোয়ার মোকাররম বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের রোমানিয়া ও পোল্যাণ্ডের মিশন সমন্বয় করেছে, শিপিং করপোরেশনসহ অন্যরাও কাজ করেছে। আপনারা জানেন, রবিবার আসার কথা ছিল, কিন্তু ইস্তাম্বুলে ভারী তুষারপাতের কারণে ফ্লাইটটা বাতিল হয়েছে, যে কারণে সোমবার এসেছে।
তিনি বলেন, এটা দুঃখজনক ঘটনা। তারপরও মরদেহ দেশে ফেরানোর জন্য আমরা যার যার জায়গা থেকে কাজ করেছি। মরদেহ দেশে এসে পৌঁছেছে, এটা আমাদের জন্য স্বস্তির জায়গা।
এমপি রিমন জানান, মঙ্গলবার সকাল ১০টায় গ্রামের বাড়ির পাশের মাঠে হাদিসুরের জানাজা হবে। এরপর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে তাকে।
দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়