ইসরায়েলকে ছাপিয়ে বিশ্বসেরা ড্রোন এখন তুরস্কের
আধুনিক সামরিক ড্রোন তৈরি করে বিশ্বকে প্রথম চমকে দিয়েছিল ইসরায়েল। শত্রুতা ভুলে পশ্চিম এশিয়ার সেই ইহুদি রাষ্ট্রের থেকে মানববিহীন উডুক্কু যান কেনার আগ্রহ ছিল তুরস্কের।
সব যখন প্রায় ঠিক, তখনই বাদ সাধল ইসরায়েলের দেওয়া শর্ত। ফলে বাতিল হয় ওই ড্রোন চুক্তি।
সামরিক ড্রোন বিক্রির ক্ষেত্রে ইসরায়েল শর্ত দিয়েছিল, তাদের সেনারাই সেগুলিকে পরিচালনা করবে। কারণ মানববিহীন এই হাতিয়ার আকাশে ওড়ানোর মতো ক্ষমতা বা প্রশিক্ষণ নেই তুরস্কের। এ শর্তে আঙ্কারা ইসরায়েলের মতলব বুঝতে পেরে চুক্তি বাতিল করে।
ইসরায়েলের সঙ্গে চুক্তি ভেঙে যাওয়ার পরই ঘরের মাটিতে সামরিক ড্রোনের হাব তৈরির পরিকল্পনা করে ফেলে তুরস্ক। যাতে মিশে ছিল ইহুদিদের অপমানের জবাব দেওয়ার প্রতিজ্ঞা। সেখানকার প্রযুক্তিবিদ ও প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় কয়েক দশকের মধ্যে সবাইকে ছাপিয়ে যায় ইউরোপ-এশিয়ার সঙ্গমস্থলের এই দেশ।
সম্প্রতি, তুরস্কের সামরিক ড্রোন নিয়ে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে ‘সেন্টার ফর এ নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি’ (সিএনএএস) নামের একটি সংস্থা।
সেখানে বলা হয়েছে, সামরিক ড্রোনের ক্ষেত্রে আমেরিকা, চীন ও ইসরায়েলের কাছ থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রয়েছে আঙ্কারা। যা যে কোনো যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দিতে পারে।
রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, ২০১৮ সালে আমেরিকা, চীন ও তুরস্ক যৌথভাবে ৪০টি দেশে ৬৯ ধরনের হাতিয়ারযুক্ত ড্রোন বিক্রি করেছিল। তার পর থেকে বিভিন্ন দেশের আঙ্কারার মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলির উপর নজর পড়ে। ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে ড্রোনের বাজারে ‘বড় খেলোয়াড়’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে এশিয়া মাইনরের এই দেশ।
আমেরিকান সংস্থা সিএনএএসের দাবি, ২০১৮ সালের পর থেকে হাতিয়ার যুক্ত সামরিক ড্রোন বাজারের ৬৫ শতাংশ তুরস্কের দখলে চলে গিয়েছে। ২৬ শতাংশ রয়েছে চীনের হাতে। সেখানে আমেরিকা ড্রোন বাজারে জায়গা পেয়েছে মাত্র ৮ শতাংশ।
তুরস্কের ড্রোনের চাহিদা বৃদ্ধির নেপথ্যে মূল কারণ হিসাবে এর সস্তা দরকে উল্লেখ করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ড্রোনগুলির রক্ষণাবেক্ষণ এবং যুদ্ধের সময় হামলার পদ্ধতিও খুবই সরল। যা সেনা জেনারেলদের সহজেই আকৃষ্ট করছে।
আঙ্কারা নির্মিত ড্রোনগুলির মধ্যে আবার ‘বাইরাকতার টিবি-২’-এর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। ২০২২ সালে ৬টি নতুন দেশকে যা বিক্রি করেছে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগানের সরকার। এশিয়া এবং ইউরোপের আরও কিছু দেশ এই মানববিহীন উডুক্কু যানগুলি কেনার ব্যাপার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বাইরাকতার টিবি-২ পুরোপুরি হাতে পাওয়ার পর তা বিদ্রোহী ‘কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি’-র উপর প্রয়োগ করা শুরু করে তুরস্কের সেনাবাহিনী। ২০২০ সালে নাগোরনো-কারাবাখের দখল নিয়ে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজানের মধ্যে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ।
যার ফলাফল আজারবাইজানি বাহিনীর অনুকূলে নিয়ে যাওয়ার নেপথ্যে বড় ভূমিকা পালন করেছিল এই তুর্কি ড্রোন।
২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে ফের খবরের শিরোনামে চলে আসে বাইরাকতার টিবি। তুরস্কের এই ড্রোন দিয়ে রুশ বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি করতে সক্ষম হয় ইউক্রেনীয় সেনারা। লম্বা দূরত্ব পাড়ি দিয়ে ড্রোনগুলি হামলা চালায় মস্কোতেও। কিছু ক্ষেত্রে যা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও রাডারকে ফাঁকি দিতেও সক্ষম হয়েছে।
এই তিনটি সংঘর্ষ বাদ দিলে লিবিয়ার যুদ্ধেও ব্যবহার হয়েছে এ তুর্কি ড্রোন। ২০১৪ সালে ড্রোন বিক্রিতে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে ছিল চীন। নাগোরনো-কারাবাখের যুদ্ধের পর ২০২১ সালে সেই জায়গা ছিনিয়ে নেয় তুরস্ক। আর অনেকটা পিছিয়ে পড়ে আমেরিকা, রাশিয়া এবং ইসরায়েল।
সিএনএএসের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের পর থেকে আফ্রিকার বহু দেশে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে সক্ষম বাইরাকতার টিবি সরবরাহ করেছে তুরস্ক। যা সেখানকার গৃহযুদ্ধকে আরও রক্তক্ষয়ী করছে। বিষয়টি নিয়ে রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকার ওই সংস্থা।
প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দাবি, তুরস্কের এই ড্রোনটিকে পছন্দ করে আমেরিকার তৈরি শক্তিজোট ‘ন্যাটো’ ভুক্ত রাষ্ট্রগুলিও। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের চারটি এবং ন্যাটোর ৬টি দেশের অস্ত্রাগারে এই ড্রোন আছে বলে জানা গিয়েছে।
২০২৩ সালে তুরস্কের থেকে এই ড্রোন কেনে পাকিস্তান। যা সাড়ে সাত হাজার কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম। ১ হাজার ৩০০ কেজি ওজন নিয়ে দিব্যি দীর্ঘ সময় আকাশে ভেসে থাকতে পারে এই ড্রোন। এক কথায় বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এরদোগানের দেশের নির্মিত এই ড্রোন।