November 24, 2024
আন্তর্জাতিকলেটেস্টশীর্ষ সংবাদ

ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনে ইউরোপে ফিরলো যুদ্ধ

দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
বৃহস্পতিবার ভোর থেকে রাশিয়ার সেনাবাহিনী বিভিন্ন দিক থেকে ইউক্রেনের সামরিক স্থাপনাগুলোর ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। অনেকে ধারণা করছেন, এই আক্রমণ ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলার সূচনা। ইউক্রেনের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিবিসি সংবাদদাতারা। পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত দনেৎস্ক এবং লুহানস্ককে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার স্বীকৃতি দেয়ার পর খেকেই ওই অঞ্চলে উত্তেজনা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরু হওয়ার পর রাজধানী কিয়েভের কাছ থেকে এক সাংবাদিক সেখানকার পরিস্থিতি তুলে ধরে জানিয়েছেন, তিনি সাতটি রকেট বিস্ফোরণের শব্দ শুনেছেন। কিয়েভের নিকবর্তী একটি সামরিক ঘাঁটির কাছে বসবাস করা এই সাংবাদিকের নাম লুবোভ ভেলিচকো বলে জানিয়েছে বিবিসি।
ভেলিচকো জানান, ‘প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দে’ ভোররাত সাড়ে ৪টার দিকে ঘুম ভেঙে যায় তার, কী হচ্ছে কিছু জানতেন না তিনি। আমি বাইরে বের হয়ে আসি আর আগুনের মতো কিছু দেখলাম। ভেলিচকো জানান, তার প্রতিবেশীরা প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে আর তাদের মধ্যে কয়েকজন কাঁদছিলেন।
পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত আজোভ সাগরে বাডুজ্যিক নৌযানের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে রাশিয়া, তবে নৌ চলাচলের জন্য কৃষ্ণ সাগরের জলপথ খোলা রেখেছে। বৃহস্পতিবার একাধিক কর্মকর্তা ও শস্য খাতের কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। বিশ্বের সর্ববৃহৎ গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া মূলত তার কৃষ্ণ সাগরের বন্দরগুলো থেকেই জাহাজে শস্য সরবরাহ করে। আজোভ সাগরে দেশটির স্বল্প ধারণক্ষমতার একাধিক অগভীর বন্দর আছে।
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর লিথুয়ানিয়ার দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছেন প্রেসিডেন্ট গিতানাস নাউসেদা। তবে বিষয়টি পার্লামেন্টে পাস হতে হবে। বেলারুশ ও রাশিয়ায় বিপুল সৈন্য সমাবেশের প্রেক্ষিতে নেটো জোটভুক্ত দেশগুলোকে সীমান্তে সৈন্য মোতায়েনের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। এক সময় মস্কোর শাসনে থাকা লিথুয়ানিয়া এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য, সামরিক জোট নেটোতেও তারা আছে। দেশটির সীমান্ত রয়েছে বেলারুশের সাথে। বেলারুশ থেকেও ইউক্রেনে আক্রমণ করছে রাশিয়া। রাশিয়ার কালিনিনগ্রাদ পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার মধ্যবর্তী একটি ছিটমহল।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলজ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের ‘অযৌক্তিক এবং স্পষ্ট লঙ্ঘন’ হিসাবে বর্ণনা করে এর নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বার্লিন তার অংশীদার জি-৭, নেটো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে এ ব্যাপারে পরামর্শ করবে। ইউক্রেনের জন্য এটা ভয়ানক এক দিন এবং ইউরোপের জন্য একটি অন্ধকার দিন।
‘কঠোর নিষেধাজ্ঞা’ দেবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন : ইউক্রেনে ‘বর্বরোচিত’ হামলার জন্য রাশিয়ার বিরুদ্ধে ‘নতুন ও কঠোর’ নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুঁশিয়ারি দিয়েছে ২৭ দেশের জোট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। বৃহস্পতিবারের পর এক জরুরি বৈঠকে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন জোটের নেতারা। ইইউ প্রধান উরসুলা ফন ডার লেইন বলেছেন, ইউরোপে যুদ্ধ ফেরানোর জন্য দায়ী প্রেসিডেন্ট পুতিন। ইইউ তাকে এর জন্য দায়ী করবে।
রাশিয়ার প্রধান প্রযুক্তিখাত এবং বাডুজ্য ক্ষেত্রগুলোকে নতুন নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হবে জানিয়ে এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আমরা রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভিত্তি এবং তার আধুনিকীকরণের ক্ষমতা দুর্বল করব। আমরা ইইউতে রাশিয়ান সম্পদ জব্দ করব এবং ইউরোপের বাজারে রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর প্রবেশ বন্ধ করব।
ইউক্রেনের দুই অঞ্চলকে রাশিয়া স্বীকৃতি দেওয়ার পর বুধবার প্রথম দফায় নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ। রাশিয়ার শীর্ষ রাজনীতিবিদদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয় সেখানে। ব্রিটিশ জুনিয়র পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস ক্লেভারলিও বলেছেন, পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেবে, তা হবে ‘নজিরবিহীন’। স্কাই নিউজকে তিনি বলেন, আমরা আমাদের আন্তর্জাতিক বন্ধু এবং মিত্রদের সঙ্গে মিলিত হচ্ছি। রাশিয়ার ভয়ঙ্কর এই সিদ্ধান্তের শাস্তি হিসাবে অভূতপূর্ব ও সমন্বিত নিষেধাজ্ঞার আরোপ করতে যাচ্ছি।
৫০ রুশ সেনা নিহত, ৪ ট্যাংক ধ্বংস: ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, পূর্বাঞ্চলীয় শহর খারকিভের কাছে একটি রাস্তায় রাশিয়ার চারটি ট্যাংক তারা ধ্বংস করেছে। লুহানস্ক অঞ্চলের একটি শহরের কাছে ৫০ রুশ সেনাকে তারা হত্যা করেছে। এ ছাড়া রাশিয়ান বিমান ভূপাতিত করার দাবিও তারা জানিয়েছে। ট্যাংক ধ্বংস কিংবা বিমান ভূপাতিত হওয়ার খবর অস্বীকার করেছে রাশিয়া। এদিকে ইউক্রেনের বর্ডার গার্ড সার্ভিস জানিয়েছে, দক্ষিণ খেরসন অঞ্চলে তাদের তিনজন সেনা নিহত হয়েছেন এবং আরও কয়েকজন আহত হয়েছেন।
ইউক্রেনে যুদ্ধ নেটোর উসকানিতে: পশ্চিমা সামরিক জোট নোটোর ‘উসকানিমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে’ ইউক্রেনে যুদ্ধের সূচনা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার মিত্র দেশ ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমিরাবদুল্লাহিয়ান। বৃহস্পতিবার এক টুইটে তার এ মন্তব্য আসে। ইউক্রেন ভুখণ্ডে রাশিয়ার আক্রমণের মধ্যে কিয়েভ আনুষ্ঠানিকভাবে মস্কোর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্নের ঘোষণা দিয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি এই ঘোষণা দেন।
নাগরিকদের যুদ্ধে নামার আহ্বান জেলেনস্কির: দেশকে রক্ষায় রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনের নাগরিকদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। তিনি বলেছেন, যারা অস্ত্র চাইবে তাদের তা দেওয়া হবে। স্থল, আকাশ ও সমুদ্রে পথে ইউক্রেনে সর্বাত্মক আক্রমণ চালাচ্ছে রাশিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের কোনো দেশ একই মহাদেশের অন্য দেশে এত বড় আক্রমণ চালায়নি।
রাশিয়ার সামরিক যানগুলো উত্তরে বেলারুশ ও দক্ষিণে ক্রিমিয়া থেকে শুরু করে একাধিক দিক দিয়ে ঢুকছে। পূর্ব দিকের খারকিভ ও লুহানস্ক অঞ্চল দিয়েও রুশ সেনারা প্রবেশ করছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেন। দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, সামরিক যান নিয়ে এগোনোর আগে রুশ বাহিনী গোলাবর্ষণ করছে। বন্দরনগরী ওডেসার বাইরে অবস্থিত সামরিক ইউনিট পোডিলস্কে রাশিয়ার হামলায় ৬ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা। এছাড়া মারিউপোল শহরে একজন নিহতের খবর পাওয়া গেছে।
আগ্রাসী রুশ বাহিনীর গোলায় অন্তত আটজন নিহত হয়েছেন এবং নয়জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ইউক্রেন। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা রয়টার্সকে বলেছেন, আকাশ পথে এবং ভূমিতে বড় ধরনের আক্রমণ শুরু করেছে রাশিয়া। শেরনিহিভ, খারকিভ ও লুহানস্ক এলাকা দিয়ে রুশ স্থলবাহিনীর কলাম ইউক্রেনের সীমানায় ঢুকে পড়েছে বলে সীমান্তরক্ষীদের বরাতে জানিয়েছে রয়টার্স।
রাশিয়াকে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জাতিসংঘ মহাসচিবের : শেষ মুহূর্তের চেষ্টা হিসেবে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে ‘মানবতার নামে’ যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ইউক্রেন নিয়ে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি এক বৈঠকের পর তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট পুতিন, মানবতার দোহাই, আপনার সেনাদের রাশিয়ায় ফিরিয়ে নিন। যুদ্ধ ইউক্রেনের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি নিয়ে আসবে এবং বিশ্ব অর্থনীতিতে এর পরিণতি সুদূরপ্রসারী হবে বলেও সতর্ক করেছেন তিনি।
ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে ‘সামরিক অভিযানের’ ঘোষণা দেওয়ার পর দেশটির যুদ্ধাঞ্চলে অবস্থানরত ইউক্রেনীয় সেনাদের অস্ত্র তাগ করে বাড়ি যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রক্তপাত হলে সেজন্য ‘কিয়েভ দায়ী থাকবে’ মন্তব্য করে তিনি বলেছেন, ‘ন্যায় ও সত্য’ রাশিয়ার পক্ষে। রাশিয়ার সঙ্গে কেউ লড়াই করতে এলে মস্কো ‘তাৎক্ষণিক’ জবাব দেবে। বুধবার পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ‘আগ্রাসন’ প্রতিরোধে মস্কোকে সাহায্যের অনুরোধ জানানোর পর পুতিন এ ঘোষণা দিলেন।
ইউক্রেনের দনবাস অঞ্চলে ‘সামরিক অভিযানের’ ঘোষণা দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। বৃহস্পতিবার সকালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ থামানোর আহ্বান জানানোর মধ্যেই এক টেলিভিশন ভাষণে পুতিন এই অভিযানের ঘোষণা দেন। পুতিনের এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে ইউরোপে একটি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।

দক্ষিণাঞ্চল প্রতিদিন/ জে এফ জয়

শেয়ার করুন:

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *