আমদানির খবরে ডিমের দাম হালিতে ১০ টাকা কমেছে
দাম নিয়ন্ত্রণে ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে সরকার। আমদানিতে শুল্ক কমানোর সুপারিশও এসেছে।
সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে বাজার তদারকি। এতে কমতে শুরু করেছে পণ্যটির দাম। মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ডিমের দাম প্রতি ডজনে ৩০ টাকা কমেছে। বর্তমানে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকা। যা দুই দিন আগেও বিক্রি হয়েছে ১৮০ টাকায়।
ডিম ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় সাম্প্রতিক বন্যার কারণে পোলট্রি শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ডিমের সরবরাহ কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে দামে। তবে ডিম উৎপাদনে পরিপূরক অন্যান্য খাদ্যপণ্যের উচ্চদামকে ডিমের মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ।
কিছু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট করেও ডিমের দাম বাড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করে তারা আরও বলেন, সরকারের এসব পদক্ষেপে ডিমের দাম কিছুটা কমলেও তা হবে সাময়িক। ডিমের দাম ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনতে হলে ডিমের উৎপাদন খরচ কমানো ও সিন্ডিকেটকারীদের (অসাধু জোট) বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি বাজারে ডিমের দাম কয়েক দফায় বেড়েছে। একপর্যায়ে ঢাকার বাজারে প্রতি ডজন ফার্মের ডিমের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১৮০ থেকে ১৯০ টাকায়।
শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) রাজধানীর কয়েকটি খুচরা ও পাইকারি বাজার এবং বিভিন্ন পাড়া,মহল্লায় ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে ফার্মের মুরগির এক ডজন ডিম বিক্রি হয়েছে ১৫০ টাকায়। পাইকারি আড়ত কাপ্তান বাজারে তা ১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও দুই দিন আগে খুচরা পর্যায়ে এক ডজন ডিম কিনতে ১৮০–১৯০ টাকা লাগত।
প্রসঙ্গত, গত ১৬ সেপ্টেম্বর কৃষি বিপণন অধিদপ্তর সম্প্রতি ডিমের ‘যৌক্তিক দাম’ নির্ধারণ করে দেয়। প্রতিটি ডিমের দাম উৎপাদন পর্যায়ে ১০ টাকা ৫৮ পয়সা, পাইকারি পর্যায়ে ১১ টাকা ০১ পয়সা ও খুচরা পর্যায়ে ১১ টাকা ৮৭ পয়সা (ডজন ১৪২ টাকা ৪৪ পয়সা) বেঁধে দেওয়া হয়। তবে বাজারে এখনও ১৫০ টাকা দরে ডিম বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ এখন সরকারের নির্ধারিত যৌক্তিক মূল্যের চেয়েও ডজনে প্রায় ৮ টাকা বেশি দামে ডিম বিক্রি হচ্ছে।
ভোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ডিমের বাজারে এখনো শক্ত একটা সিন্ডিকেট কাজ করছে। আওয়ামী লীগের পতন হলেও বর্তমান সরকার বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তা না হলে সরকার দাম নির্ধারণ করে দেওয়ার পরও কেন কার্যকর হয়নি।
বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মো. কবির শেখ। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বেশি দামের কারণে পছন্দের মাছ–মাংস কিনে খেতে পারি না। এজন্য নিয়মিত ডিম কেনা লাগে। ডিম ছিল বলে একবেলা ঝোল-ভাত খাওয়ার সাধ মেটে। কিন্তু এ পণ্যটি কিনতেও হিমশিম খেতে হয় আমাদের।
রায়সাহেব বাজারে ডিমের ব্যবসায়ী মো. সোহরাব হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, সরকার ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার পর থেকেই ডিমের দাম কমতে শুরু করেছে। গত দুই দিনে ডিমের দাম প্রতি হালিতে ১০ টাকা কমে এখন বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকা হালিতে। যা দুই দিন আগেও ছিল ৬০ টাকা হালি। তবে বাজারে এখনও আমদানি করা ডিম আসেনি। কয়েকদিনের মধ্যেই সে ডিম বাজারে চলে আসবে।
তখন দাম আরো কমবে বলে জানান তিনি।
সূত্রাপুর বাজারে ডিম ব্যবসায়ী মো. সুমন বেপারী বলেন, আমরা আড়ত থেকে ডিম এনে খুচরা ও পাইকারি বিক্রি করি। সেখানে কম দাম পেলে কমে আর বেশি দাম পেলে বেশি দামে বিক্রি করি। গত দুই দিন ধরে ডিমের দাম একটু কমতির দিকে। আজকে প্রতি হালি ডিম ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। যা আগে ৬০ থেকে ৬২ টাকায় বিক্রি করেছি। সে হিসেবে দাম ১০ থেকে ১২ টাকা কমেছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে দেখা গেছে, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে ডিমের দাম বছরজুড়ে ডজন ৮০ থেকে ১১০ টাকার মধ্যে ছিল। যুদ্ধ শুরুর ছয় মাসের মাথায় ডিমের দাম বেড়ে ১২৫–১৩৫ টাকা হয়, যা গত বছরের শেষ নাগাদ ১৫০–১৬৫ টাকায় পৌঁছায়। এরপর অনেকটা কাছাকাছি দামেই ডিম বিক্রি হয়ে আসছিল। যদিও সম্প্রতি এই দাম ১৮০ টাকা ছাড়িয়ে যায়।
বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুরগির ডিম উৎপাদন খরচের ৮০–৮৫ শতাংশ যায় পোলট্রি খাদ্যের দামের পেছনে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর বেড়ে যাওয়া পোলট্রি খাদ্যের দাম এখন কমেছে। তবে কমেনি ডিমের দাম। যদিও খাদ্য উৎপাদনকারীরা বলছেন, মার্কিন ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে খাদ্যের দাম কমানো সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে বাজারে সরবরাহ বাড়াতে অন্তর্বর্তী সরকার গত ৮ অক্টোবর সাতটি প্রতিষ্ঠানকে সাড়ে ৪ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ডিম এসেছে সামান্যই। টানা চার দিন সরকারি ছুটি থাকায় আমদানি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ায় ডিম আমদানি খুব বেশি হয়নি।
ফলে গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নতুন করে আরো সাড়ে চার কোটি ডিম আমদানির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়। এই দফায় অনুমতি দেওয়া হচ্ছে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে। এই দফায় ডিম আমদানি করার ক্ষেত্রে কয়েকটি শর্ত দেওয়া হয়েছে। এর প্রথমটি হলো – এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুমুক্ত দেশ থেকে ডিম আমদানি করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমদানি করা ডিমের প্রতিটি চালানের জন্য রপ্তানিকারক দেশের সরকার কর্তৃক নির্ধারিত বা ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দেওয়া এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লু ভাইরাস ও ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া মুক্ত সনদ দাখিল করতে হবে।
তৃতীয়ত, ডিম আমদানির প্রতিটি চালানের কমপক্ষে ১৫ দিন আগে সংশ্লিষ্ট সঙ্গনিরোধ কর্মকর্তাকে জানাতে হবে।
চতুর্থত, আমদানির অনুমতি পাওয়ার পরে সাত দিন পর পর অগ্রগতি প্রতিবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দাখিল করতে হবে। এর আগে গত মাসেও এক দফায় ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছিল সরকার।
অন্যদিকে বর্তমান ডিম আমদানিতে ৩৩ শতাংশ শুল্ক-কর রয়েছে। ডিমের সরবরাহ বৃদ্ধি ও বাজারদর স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে এই শুল্ক–কর সাময়িকভাবে প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে ট্যারিফ কমিশন।
এ ছাড়া ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার পরিস্থিতি তদারকের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের ঘোষণা দেয় সরকার। দেশের সব জেলা পর্যায়ে এ টাস্কফোর্স আলাদাভাবে কাজ করবে। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও নিয়মিত বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে।
গতকাল বৃহস্পতিবার (১৭ অক্টোবর) মতিঝিলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই) ভবনে ডিম, ব্রয়লার মুরগি, আলু, পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের বাজারবিষয়ক মতবিনিময়সভায় তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আমান উল্লাহ জানান, উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ডিমের পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকলে আজ শুক্রবার থেকে খুচরা পর্যায়ে ৪৮ টাকায় হালি ও ১৫০ টাকায় এক ডজন ডিম বিক্রি করা হবে।
আমান উল্লাহ জানিয়েছেন, তেজগাঁও আড়তে দৈনিক ডিমের চাহিদা ২০-২৫ লাখ পিস। বিপরীতে করপোরেট কোম্পানিগুলো সরবরাহ করছে মাত্র ১০ লাখ ডিম। বাড়তি ডিম বিভিন্ন উৎস থেকে সংগ্রহ করতে হচ্ছে। তবে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত সরবরাহ করলে শুক্রবার সকাল থেকে খুচরা পর্যায়ে ৪৮ টাকা হালি ডিম বিক্রি করা সম্ভব হবে। আর প্রতি ডজন ডিম বিক্রি করা যাবে ১৫০ টাকায়। সে অনুযায়ীই পাইকারি পর্যায়ে দাম রাখা হবে।
প্রান্তিক খামারিদের সংগঠন বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, ঢাকাকেন্দ্রিক একটি চক্র ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারাই ইচ্ছেমতো দাম বাড়ায়। এতে ক্ষুদ্র খামারিরা সঠিক দাম পান না। আর ক্রেতারাও বেশি দামে ডিম কেনেন।
বাংলাদেশ এগ প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি তাহের আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পর থেকে ডিম উৎপাদনের পরিপূরক খাদ্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়েছে। ডিম উৎপাদন খরচ না কমলে ডিমের দামও কমবে না।
তবে অভিযান কোনো সমাধান নয়। অভিযান ও জরিমানার ভয়ে ডিমের দাম কমিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ীরা। এভাবে বেশি দিন দাম কমিয়ে রাখা যাবে না।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের উৎপাদনের তথ্য বলছে, ২০১০ সালে দেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ৬০০ কোটি পিস, যা এখন ১ হাজার ৭৩৬ কোটিতে পৌঁছেছে। অর্থাৎ এক দশকে উৎপাদন প্রায় তিনগুণ বেড়েছে। দেশে প্রতিদিন মুরগি, হাঁস, কবুতর ও কোয়েলের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। পৃথক হিসাবে, কেবল মুরগির ডিম উৎপাদন হয় সাড়ে তিন থেকে চার কোটি। হাঁসের ডিমের সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।