মাদক ছেড়ে সমাজে ভালো থাকার চেষ্টায় রাব্বি-রীনা-রুবিনারা
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
হঠাৎ করেই বাবার মৃত্যুর পর দিশেহারা হয়ে পড়ি, পরিবারের একমাত্র ছেলে হওয়ায় বিভিন্ন দুঃশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে সময় কাটাতে থাকি। এরইমধ্যে প্রতিবেশী মামুন হাওলাদারের সঙ্গ পেয়ে মাদক সেবন ও ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ি।
শুরুতে হাতে নগদ টাকা আসতে থাকায় বেশ আগ্রহ তৈরি হয় মাদক ব্যবসায়, কিন্তু যখন বিষয়টি পুলিশের কানে গিয়ে গড়ায় তখনই বেড়ে যায় উদ্বেগ। মাদকসহ যাতে ধরা না পড়ি এ আতঙ্কে পুলিশের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়িয়েছি, কিন্তু একদিন ধরা পড়তেই হয়েছে। এরপর তো কোনদিন ভাবিনি যে এ পথ থেকে ফিরে আসতে পারবো। আর এখন মাদক সেবন-ব্যবসা সব ছাড়তে পেরেছি, তার ওপর পুলিশের সহযোগিতায় স্বাভাবিক জীবনে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ভালো ও সুন্দর দিন কাটাচ্ছি।
এ কথা গুলো বলছিলেন বরিশালের উজিরপুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আবুল হোসেনের ছেলে গোলাম রাব্বি। যিনি প্রায় গত দু’বছর আগে উজিরপুর থানা পুলিশের হাত ধরে মাদকবিক্রি ছেড়ে দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে বরিশাল পুলিশ রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শফিকুল ইসলামের আহŸানে আত্মসমর্পণ করেন।
রাব্বির মতে, যখন তিনি মাদকের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তখন তার সঙ্গে পরিবারের লোকজনসহ কেউ ভালোভাবে কথা বলতো না, দিনরাত কাটতো গ্রেফতার আতঙ্কে। তবে বর্তমানে তিনি স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে বেশ ভালো আছেন।
রাব্বি বলেন, আত্মসমর্পণের পর পুলিশের পক্ষ থেকে পাওয়া ভ্যানটি বর্তমানে আমি ভাড়া দিয়ে রোজগার করছি। তার সঙ্গে পুরাতন একটি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা তিনি চালাচ্ছেন। একটি মামলা ছিল তা থেকেও বছরখানেক পূর্বে অব্যাহতি পেয়েছেন। সবমিলিয়ে এখন আয়টা যেমন ভালো, তেমনি ঝামেলাও নেই কোনো।
তিনি বলেন, মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকার সময়টার জীবনটা যে কতো দুর্বিসহ ছিল, তা কেউ বিশ্বাস করবে। আর এখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে যে কতো ভালো আছি তা না দেখেও কেউ বুঝবে না। আমি বলবো কোনো বিপদেই যেন অসৎ সঙ্গে কেউ না মিশে, আর সবাই যেন মাদকের এ পথ থেকে ফিরে আসে। আর সরকারও যেন সবাইকে ভালো হওয়ার সুযোগ দেয়।
শুধু রাব্বি নয়, মাদক থেকে ফিরে এসে বরিশাল বিভাগের বিভিন্ন জেলায় অনেক নারী-পুরুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। যা স্থানীয়দের কাছেও বেশ ভালো লাগার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বড় কসবা এলাকার করিম চোকদারের স্ত্রী রীনা ছিলেন একজন মাদকবিক্রেতা। তিনি প্রায় গত ১৮ মাস আগে আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মাদকবিক্রি ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন।
স্থানীয় মুদি ব্যবসায়ী জাকির হোসেন বলেন, এমন কোনো দিন নেই যে মাদকসেবীরা তার বাড়ির সামনে এসে ভিড় না করতো। কিন্তু দেড়বছরের বেশি সময় ধরে সেখানে কেউ আসে না। মাঝেমধ্যে পুলিশের লোক আসে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা রীনার খোঁজ নিতে।
জানা যায়, পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া সহায়তা নিয়ে গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি পালন করেন রীনা। আর তার স্বামী করিমও গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরু বেচাকেনা করেন।
রীনা জানান, মাদকবিক্রি ছেড়ে দেওয়ায় মানুষ এখন ভালোভাবে আমাদের সঙ্গে মিশে। তবে কিছু প্রতিবেশী রয়েছে যারা বিভিন্নভাবে ভালো হওয়াটাকেও নিরুৎসাহিত করছেন।
ঝালকাঠি জেলা সদরের নতুন কলাবাগান এলাকার মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত মনিরুজ্জামান পিন্টু (৪০) ও রুবিনা (৩৫) মাদকবিক্রি ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে জীবিকা নির্বাহ করে তিন সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন। তাদের বিরুদ্ধে চারটি মাদক মামলা থাকলেও এখন মাদকবিক্রি করেন না বিধায় নতুন করে কোনো ঝামেলা হচ্ছে না। তবে কাঠমিস্ত্রি (কুনমিস্ত্রি) স্বামীর স্বল্প আয়ে মামলার ব্যয় পরিচালনা ও সন্তানদের পড়ালেখা করাতে হিমশিম খেতে হয় তাকে। সেলাইয়ের কাজ জানেন না বিধায় পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া মেশিনটিও বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন একটু ভালোভাবে জীবযাপন করার জন্য স্বামীকে একটি দোকান করে দেওয়ার জন্য সবার কাছে আকুতি জানিয়েছেন রুবিনা। পাশাপাশি মামলার খরচ রোধে লিগ্যাল এইডের সহযোগিতাও চান তিনি। সেই সঙ্গে সমাজের সবাইকে মাদক থেকে দূরে থাকার আহŸান জানিয়েছেন রুবিনা। শুধু মাদক ব্যবসায়ীরাই নয়, মাদকসেবীরাও আত্মসমর্পণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে মাদকসেবন ছেড়ে দিয়ে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছেন।
বরিশালের উজিরপুর উপজেলার গুঠিয়া এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হালিম হাওলাদার (৫২) ও থ্রি-হুইলার চালক ইউনুস (৪৮) দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় গাঁজা সেবন করতেন। কিন্তু ১৮ মাস আগে থানা পুলিশের সতর্কতামূলক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তারা মাদকসেবন ছেড়ে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। এরপর তারা পুলিশের কাছ থেকে দুই দফায় সহায়তা পান। যার মধ্য দিয়ে হালিম তার ব্যবসা গুছিয়ে নিয়েছেন এবং ইউনুস গাড়ি চালিয়ে আয় করছেন। তবে তার গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করার জন্য আর্থিক সহায়তার প্রয়োজনের কথা জানিয়েছেন প্রশাসনকে। সেটি ঠিক হয়ে গেলে তার দিন ভালোই কাটবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। হালিম ও ইউনুসের দাবি, অসৎ সঙ্গের বন্ধুদের হাত ধরেই মাদকসেবনের যাত্রা শুরু। আর এরপর দীর্ঘ পথ চলা। যে পথচলায় শুধু পাগলামী আর অর্থের অপচয়ই ছিল মূল লক্ষ্য। পরিবার-পরিজন থেকে দূরে থাকতে-থাকতে কখনো বুঝতেই পারেননি যে এক যুগ হারিয়ে ফেলেছেন। তাই এখন সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্নে বিভোর হালিম ও ইউনুস।
জানা যায়, গত ২ বছরে বরিশাল রেঞ্জের ডিআইজি শফিকুলের উদ্যোগে বিভাগের ছয়টি জেলার প্রায় এক হাজার ৪০০ শত মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের এ সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৩৪৩ জনকে পাঠানো হয়েছে মাদক নিরাময় কেন্দ্রে। যারমধ্যে অনেকেই ভালো হয়ে এসেছেন। অনেকেই আবার সমাজের স্বাভাবিক ধারায় জীবন-যাপন করার চেষ্টা করছেন। যার দৃষ্টান্ত রাব্বি, রীনা, রুবিনাদের মতো কেউ কেউ সৃষ্টিও করে ফেলেছেন।
সমাজকে মাদকমুক্ত করতে অভিযানের পাশাপাশি চালানো হচ্ছে সচেতনতামূলক প্রচার প্রচারণা, দেওয়া হচ্ছে আত্মসমর্পণের সুযোগ বাংলানিউজকে এমনটাই জানালেন ডিআইজি শফিকুল।
আত্মসমর্পণ করছে তাদের মামলার খরচ যাতে না দিতে হয় সেজন্য লিগ্যাল এইড সহায়তা, আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষে প্রশিক্ষণ দেওয়া, সেলাই মেশিন, ভ্যানসহ বিভিন্ন সামগ্রী দেওয়া। সর্বোপরি তাদের একটি কাঠামোর মধ্যে রাখতে জেলা ভিত্তিক সমিতি গঠন করা হয়েছে বলেও জানান ডিআইজি শফিকুল।