দিল্লিতে মুসলিম ভাইদের পাহারায় হলো হিন্দু বোনের বিয়ে
দক্ষিণাঞ্চল ডেস্ক
মঙ্গলবার (২৫ ফেব্রæয়ারি) রাত। হাতে মেহেদী রাঙিয়ে বিয়ের সাজে বসে আছে কনে। কেবল বর এলে শুভলগ্নে বিয়ে হওয়ার অপেক্ষা। কিন্তু ২৩ বছর বয়সী কনে সাবিত্রী কেঁদেই চলছিল। তখন যে দাঙ্গা-সহিংসতায় শুভলগ্ন পেরিয়ে যাচ্ছিল।
সাবিত্রীদের বাড়ির চারপাশে সহিংসতার কারণে বরের আসার পথ বন্ধ। মানে বিয়ে অসম্ভব। এই অবস্থায় যেন অথৈ সাগরে পড়েন সাবিত্রীর বাবা ভুদে প্রাসাদ। কী করবেন যখন ভেবে পাচ্ছিলেন না, তখন তার পাশে এগিয়ে আসেন মুসলিম পড়শীরা। তাদের আশ্বাসে ভুদে প্রাসাদ পরদিন বুধবার (২৬ ফেব্রæয়ারি) মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত নেন। আর আশ্বাস অনুযায়ী, বুধবার নিজেরা উপস্থিত থেকে সাবিত্রীর বিয়ে আনুষ্ঠানিকতা সারেন মুসলিম প্রতিবেশীরা, যেন সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা বিয়েতে কোনো ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে।
দাঙ্গা-সহিংসতায় রণক্ষেত্রে রূপ নেয়া দিল্লিতেই এমন হিন্দু-মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধের গল্প রচিত হয়েছে। শুক্রবার (২৮ ফেব্রæয়ারি) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এ খবর জানা গেছে।
সোমবার (২৪ ফেব্রæয়ারি) হলুদ সন্ধ্যার সময়ের ঘটনাটি তুলে ধরে সাবিত্রী রয়টার্সকে বলেন, ‘সেদিন বাইরে আমি অনেক হইচই শুনছিলাম। তারপরও আমি হাতে মেহেদি লাগানো শেষ করি। আশা করেছিলাম, পরের দিন (২৫ ফেব্রæয়ারি) পরিস্থিতি ভালো হবে। কিন্তু সেদিন পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে গেল।’
এতই খারাপ হলো যে, বরের আসার পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সাবিত্রীর বাবা ভুদে প্রাসাদ বাধ্য হয়ে হবু জামাইকে ঘটনাটি খুলে বলেন।
এনডিটিভি জানায়, চাঁদবাগের সহিংসতার মধ্যে মেয়ের বিয়ে নিয়ে সাবিত্রীর বাবা যখন দিশেহারা হয়ে পড়েন, তখন তাকে আশ্বস্ত করেন প্রতিবেশী মুসলিমরা। বিয়ে ভেস্তে যাওয়ার শঙ্কায় চিন্তিত ভুদে প্রাসাদকে সাহস দিয়ে তারা বলেন, বুধবার তারা নিজেরাই উপস্থিত থেকে বিয়ে দেবেন সাবিত্রীর। তখন সাবিত্রীর বাবা পরদিন বিয়ের অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত জানান হুব জামাইকে।
দিল্লির কেন্দ্রস্থল থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিগত কয়েকদিন ধরেই সা¤প্রদায়িক সহিংসতা চলছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের হামলায় এখন পর্যন্ত ৪২ জন মারা গেছেন। পুরো দিল্লির পরিস্থিতি এখন থমথমে। এরমধ্যেই সহিংসতা কবলিত ওই এলাকায় জাত-ধর্ম ভুলে সাহায্যের এমন নজিরের খবর শুনে বুধবার ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন বার্তা সংস্থা রয়টার্সের একদল সাংবাদিক। কনে সাবিত্রী প্রাসাদ ওই সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার মুসলিম ভাইয়েরাই আজ আমার সম্মান বাঁচালেন।’
রয়টার্স জানায়, মুসলিম পড়শীরা চারদিকে খেয়াল রেখে নিজেরা উপস্থিত থেকে সাবিত্রীর বিয়ে শেষ করেছেন। সাবিত্রীদের ছোট্ট ইটের ঘরে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। কনে এখন বরের বাড়িতে। বিয়েতে উপস্থিত থাকা সাবিত্রীর প্রতিবেশী সামীনা বেগম বলেন, ‘মেয়েটার জন্য আমাদের মন কাঁদছিল। কে চাইবে তাদের মেয়ের যখন আনন্দ করার কথা, তখন সে ঘরে বসে কাঁদবে?’
রয়টার্স আরও জানায়, সাবিত্রীদের বাড়ি থেকে সামনে পা বাড়ালেই মূল সড়ক। সেই পুরো সড়কটি যেন এখন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা। বাড়ি-গাড়ির সঙ্গে ভাঙা হয়েছে দোকান-পাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই চাঁদবাগেই এক সপ্তাহের জ্বালাও-পোড়াও আর সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩৮ জন। গত এক দশকের মধ্যে ভারতের রাজধানী শহরে এতটা সহিংসতার ঘটনা ঘটেনি।
ঘটনার বর্ণনায় সাবিত্রীর বাবা ভুদে প্রাসাদ বলেন, ‘আমরা নিচে নেমে দেখি চারদিকে শুধু ধোঁয়া আর ধোঁয়া। খুবই ভয়ঙ্কর অবস্থা। আমরা শান্তি চাই। বছরের পর বছর ধরে মুসলিমদের সঙ্গে আমি এই এলাকায় বসবাস করছি কিন্তু কোনো সমস্যাই হয়নি। এর (দাঙ্গা) পেছনে কাদের হাত আছে জানি না, তবে যাদের হাতই থাক, তারা আমার প্রতিবেশী নয়। আমার মুসলিম প্রতিবেশীরা আমার পরিবারের মতোই।’